Advertisement
E-Paper

প্রান্তিকের পাঠ

কালীসাধনাকে প্রান্তিক চর্চা বলাই যায়। তন্ত্রভিত্তিক এই চর্চার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ জাতপাত নেই, নারী-পুরুষ বিভাজন নেই।

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২২ ০৬:১৫
দেবী কালী।

দেবী কালী।

এই বঙ্গে দুর্গার কার্নিভাল আছে। কালীর নেই। থাকা সম্ভব নয়, কারণ, তিনি নানা জায়গায় নানা নামে খ্যাত। দক্ষিণেশ্বরে ভুবনেশ্বরী, আদ্যাপীঠে আদ্যা মা, চিৎপুরে চিত্তেশ্বরী, রাজপুরে বিপত্তারিণী, টালিগঞ্জে করুণাময়ী, নিমতলায় আনন্দময়ী। বাংলাদেশের ঢাকেশ্বরী ও যশোরেশ্বরীও বটে। কোনও রূপই এক এবং একমাত্র নয়। আগামী সোমবারের দীপান্বিতা কালীপুজোর শেষে মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাতে তিনি আসবেন রটন্তী কালী হিসাবে, জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায় আবার ফলহারিণী কালীপুজো। ভক্তের চোখে তিনি দশ মহাবিদ্যার অন্যতম। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা— এঁরাই আমাদের পরিচিত দশ মহাবিদ্যা। কিন্তু কালী ভারত জুড়ে এত জনপ্রিয় যে, সব জায়গায় এই তালিকা মেলে না। তন্ত্রসার গ্রন্থে মহাদুর্গা, কামাখ্যাবাসিনী, প্রত্যঙ্গিরাও দশ মহাবিদ্যার অন্তর্গত। প্রাচীন স্কন্দপুরাণে পার্বতী মোটেও ফর্সা নন। তাঁর গায়ের রং নিয়ে শিব এক দিন ঠাট্টা করেন। রুষ্ট দেবী গিয়ে ব্রহ্মার তপস্যায় বসেন। তপস্যাশেষে বর লাভ, দেবী কালো গাত্রচর্মটি খুলে জলাশয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার পর সেই কালো গাত্রচর্ম নিয়ে তিরধনুক, খড়্গ, ভল্ল নিয়ে আট হাতওয়ালা একটি মেয়ের আবির্ভাব। তাঁর নাম কৌশিকী। স্কন্দপুরাণে দুর্গা নিরামিষাশী, গাছের পাতা ভক্ষণ করেন। তাই তাঁর আর এক নাম অপর্ণা। অন্য দিকে, কালী কালো, রুধিরাক্ত ও মাংসাশী। মহাকবি কালিদাস আমাদের মতো দুর্গা ও কালীকে একাকার করে দেননি। তাঁর কুমারসম্ভবম্-এ হরপার্বতীর বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে আসেন স্বয়ং কালী।

কালীভক্ত কুলে যাঁরা গঞ্জিকাসেবী ভণ্ড, তাঁদের মধ্যযুগেও বিশেষ পাত্তা দেওয়া হয়নি। প্রসঙ্গত, শ্রীরামকৃষ্ণ নিচু থাকের জাদু বা সিদ্ধাই ও উঁচু থাকের সিদ্ধির তফাত করে দিয়েছিলেন। সাধনায় সিদ্ধিলাভই সাধকের পরম লক্ষ্য, সিদ্ধাই নয়। তন্ত্র মানে শুধু কালীসাধনা নয়। শাস্ত্রেরই অন্য নাম সেটি। তাই সাংখ্যদর্শনের আর এক নাম কপিলতন্ত্র, বেদান্তদর্শনের আর এক নাম উত্তরতন্ত্র। কোথাও তন্ত্রকে বেদের সঙ্গে তুলনা করা হয়, কুলার্ণবতন্ত্র আবার জানায়, বেদ গণিকা কিন্তু তন্ত্র কুলবধূর মতো, সযত্নে রক্ষা করতে হয়। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতির টীকাকার আবার বলছেন, কাপালিক ও পাশুপতদের দেখলেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের মত ও পথকে শ্রেষ্ঠ বলেছেন— এখনকার রাজনৈতিক দলগুলির মতো।

সুতরাং অতীতেও, বর্তমানেও কালীসাধনাকে প্রান্তিক চর্চা বলাই যায়। তন্ত্রভিত্তিক এই চর্চার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ জাতপাত নেই, নারী-পুরুষ বিভাজন নেই। স্বয়ং রামকৃষ্ণও তন্ত্রমার্গে ভৈরবী মায়ের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। নির্বাণতন্ত্র জানাচ্ছে, গুরুতত্ত্ব, মন্ত্রতত্ত্ব, দেবতত্ত্ব, বর্ণতত্ত্ব ও ধ্যানতত্ত্বই পঞ্চ ম কার। এ বারের কালীপুজোয় তাই বাঙালির কাজ হতে পারে— বাজি ফাটানো নয়, তন্ত্রের প্রাচীন পাঠগুলি খুঁটিয়ে দেখা। একদা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অনন্তলাল ঠাকুর, চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর মতো বাঙালি এই কাজই করে গিয়েছেন। আধুনিক দৃষ্টিতে কখনও কখনও বিসদৃশ লাগতে পারে, কিন্তু রামপ্রসাদী গানেই তো আছে, ‘রত্নাকর নয় শূন্য কখন দু’-চার ডুবে ধন না পেলে।’ চেষ্টা করলে দু’-চারটি দুর্লভ রত্ন আজও পাওয়া যাবে।

kali Puja 2022 Goddess Kali Worship
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy