কলকাতা আমার বুকে বিষম পাথর হয়ে আছে”— কবিতায় লিখিয়াছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবির শব্দগুলি উঠিয়া আসিয়াছিল কলিকাতা মহানগরীর প্রতি কবির গভীর মোহঘোর হইতে। আজ কিন্তু মহানগরের বাসিন্দারা অন্য ভাবে তাঁহার শব্দগুলিকে ফিরিয়া অনুভব করিতে পারেন। বিষম দূষণে আজ কলিকাতা ফুসফুসরূপী বিশালাকার প্রান্তর ময়দান ভারাক্রান্ত হইতে বসিয়াছে। ফুসফুসই যদি এই ভাবে বিষাইয়া যায়, তবে বাকি শহরের পাথর হইতে আর বাকি কী থাকে! বিষক্রিয়ার মাত্রা বুঝিতে পরিবেশবিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হইবার প্রয়োজন নাই। খালি চোখেই দেখা যায়, কী ভাবে যত্রতত্র জঞ্জালের স্তূপ জমিয়াছে, প্লাস্টিক হইতে জৈব জঞ্জাল সবই জমিয়া অনন্ত অপেক্ষায় রহিয়াছে— কখন কোন শুভক্ষণে প্রশাসনিক দৃষ্টিপাত হইবে, তাহার জন্য! শীতকালে এই স্তূপ কেন অতি দ্রুত বাড়িতে থাকে, বুঝিতে অসুবিধা নাই। এমনকি করোনাকালেও ময়দান প্রান্তরে মানুষের আনাগোনার অবধি নাই। আর, আনাগোনা হইবে না-ই বা কেন, শহরের কেন্দ্রস্থলে এমন একটি সবুজ ময়দান থাকিলে সেখানে তো শীতবিকালের ভ্রমণ সঙ্গত নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। অথচ মুশকিল ইহাই— নাগরিক অধিকারের সহিত অঙ্গাঙ্গি মিশিয়া থাকে দূষণের অধিকারও। তাই স্বল্প সময়ের জন্য আসিয়াও মানুষ যৎপরোনাস্তি জঞ্জাল ফেলিয়া চলিয়া যাইতে পারেন। অবশ্যই, তাহার সহিত যুক্ত হয় সাগরমেলাযাত্রীদের শিবির এবং তজ্জনিত দূষণ। কলিকাতার দুর্ভাগ্য, প্রশাসন ও নাগরিক দুই পক্ষই এই বিষয়ে একই রকম নির্বিকার। নাগরিকের কিছুমাত্র বিবেকদংশন হয় না এই ভাবে নিজের শহরকে নোংরা করিতে। এবং প্রশাসনের কিছুমাত্র চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে না, শহরের মুক্তাঙ্গনটিকে এই ভাবে দূষিত ও বিষায়িত করিয়া ফেলিয়া রাখিতে। প্রশাসনকে তাহার কাজ ঠিক ভাবে করাইবার জন্য নাগরিক মহল হইতে কোনও চাপ নাই। নাগরিককে তাহার দায়িত্ব ঠিক ভাবে মানাইবার জন্য প্রশাসনের তরফে কোনও উদ্যোগ নাই।
উদ্যোগ আছে, কিংবা ছিল, কেবল আদালতের। অতীতে, এমনকি সাম্প্রতিক অতীতেও একাধিক বার ময়দানের পরিবেশ লইয়া নির্দেশ দিয়াছিল কলিকাতা হাই কোর্ট। এই সব নির্দেশে প্রাথমিক ভাবে কিছু কর্তাদের মধ্যে নাড়াচাড়া পড়ে, তাহার পর সমস্ত সচেতনতার সমাধি ঘটে। অবশ্য ভাবিতে হইবে, মাথাব্যথা কেবল বিচারবিভাগের কেন। ময়দান পরিষ্কার রাখা না-রাখার বিষয়ে কেন আদালতকেই হস্তক্ষেপ করিতে হইবে। বিশ্বের বহু বড় শহরের কেন্দ্রভূমিতে এমন নগরহৃদয়-রূপী পার্ক রহিয়াছে, সেগুলি দেখিলে আন্দাজ পাওয়া যায় রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি কী ভাবে সেই সব শহর-প্রশাসন করিয়া থাকে। এবং কী ভাবে নাগরিক শহরের মান্য বিধি মানিয়া থাকে। ইহা তো কেবল একটি ময়দানের প্রশ্ন নহে। শহরের যে কোনও সবুজ মাঠই যে জঞ্জাল ফেলিবার অত্যুপযোগী পরিসর নহে, প্রশাসনকে তাহা বুঝিতে ও মানিতে হইবে। পুরাতন কলিকাতার বিবিধ মাঠ হইতে সল্টলেক-নিউ টাউনের মাঠ, সবই বলিয়া দেয়— সবুজের পরিচ্ছন্নতার মর্যাদা এই শহরে ক্ষীণ। অথচ সবুজ রক্ষার কাজটি কিন্তু প্রশাসনের দাক্ষিণ্য বিতরণ নহে। তাহা নাগরিকের একান্ত অধিকার। নাগরিক বাসস্থানকে পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর রূপে পাইবার অধিকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy