গণতন্ত্রের একটি মূল দায়— অন্য কারও মতামত অপ্রিয় হলেও তা সহ্য করা। স্পষ্টাক্ষরে বলা দরকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে ভাবে গণতন্ত্রের পথ থেকে ভ্রষ্ট হচ্ছে, তা রাজ্যবাসীকে ক্রমশই বড় সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে চলছে দলতন্ত্র, কোনও ভাবেই যা সমর্থনীয় নয়। দলীয় স্বেচ্ছাচারিতার ফলাফল গণতান্ত্রিক সমাজে কত ভয়ানক হতে পারে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে কথা বিলক্ষণ জানা। পূর্বতন শাসকের বিরুদ্ধে সেই বিক্ষোভে ভর করেই, তার আগুনে ঘৃতসংযোগ করেই তিনি নিজে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। তবু, যে যায় শাসনে, তারই ঘটে বিস্মরণ। ক্ষমতা হাতে এলে আরও ক্ষমতার স্পৃহা শুভাশুভ বোধ নাশ করে। গণতন্ত্রে শাসকের ক্ষমতার সীমা নিয়ে সম্প্রতি আবার বিস্তর আলোচনা শোনা গেল গত সপ্তাহে, জরুরি অবস্থার অর্ধশতক পূর্তির সূত্রে। ভারতের কেন্দ্রীয় শাসক বিজেপি কেমন করে প্রাত্যহিক জরুরি অবস্থা জারি রেখে চলেছে, এই সমালোচনাও নতুন জোর পেল। কিন্তু এই একই প্রসঙ্গে বলা দরকার, কেবল বিজেপি নয়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বময় নেত্রীও একই দোষে দোষী। গণতন্ত্রের খাতায় তাঁদের নম্বরও বহু নীচে। অনবরত বিরোধী কণ্ঠ দমন, নিষ্পেষণ, এবং বিরোধীদের ‘প্যাকেট’-এ পুরে রাখার হুমকি ও বন্দোবস্ত দিয়ে তাঁরা ক্রমশই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিকে যেন রাজনৈতিক ভাবে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্যান্য তৃণমূল নেতৃবর্গকে বুঝতে হবে, এ কেবল ভোটে হারজিতের প্রশ্ন নয়। ভোটের হিসাবে শাসক-বিরোধী যে টক্করই দিক না কেন, তার সঙ্গে আরও একটি বিবেচনা পশ্চিমবঙ্গীয় নাগরিক সমাজ দাবি করে। সেটা হল— নাগরিকের মতামত ও ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে, বাক্স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের স্বাধীনতাকে মর্যাদা দানের দাবি। অথচ আর জি কর কাণ্ড প্রমাণ, জনসমাজের দাবিকে কী ভাবে শাসক গোষ্ঠী সম্পূর্ণ অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করতে পারে, সরকারি কর্মক্ষেত্রে এক পড়ুয়া-ডাক্তারের মর্মান্তিক নিধনেরও যথার্থ বিচারে বাধা দেয়। এসএসসি কাণ্ড প্রমাণ যে, সরকারি দুর্নীতির ফলে দুর্বিষহ পরিস্থিতির দায় নিতে সরকারের মুখ পুড়ছে বলে শাসক দল সোজাসুজি শিক্ষকদের উপর দমনপীড়নের পথ নেয়। সম্প্রতি শাসকবিরোধী কার্টুন আঁকার দায়ে এক নাগরিককে এই রাজ্যে অভিযুক্ত হতে হল। একই ভাবে, গত বছর চোপড়া-কাণ্ডের পর সমাজমাধ্যমে একটি ভিডিয়ো শেয়ার করার দায়ে এমনকি সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। এ ছাড়া, যে অসংখ্য ভীতিপ্রদর্শনের দৃষ্টান্ত সাধারণ ভাবেই এ রাজ্যের সমাজে প্রত্যহ চলমান, বহমান ও কার্যকর, কিন্তু থানা কিংবা আদালতের দ্বারপ্রান্ত অবধি হয়তো তার অভিযোগ পৌঁছয় না— সে সব প্রসঙ্গ তাই আলোচনাতেও ধরা দুষ্কর। কেবল স্পষ্ট যে, এ রাজ্যে যা চলছে, তা ভোট হিসাবে গণতন্ত্র হতে পারে, কিন্তু শাসন হিসাবে দলতন্ত্র। গণতন্ত্র থেকে এই চ্যুতি পশ্চিমবঙ্গকে শেষ অবধি কোন অতলে নিয়ে যাবে, তা ভাবতেও ভয় হয়।
বাস্তবিক, এ বারের বিধানসভা অধিবেশনে স্থাপিত হল একটি বেনজির অ-গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত। বিধানসভায় বিরোধীরা বক্তব্য পেশ করতে ক্রমাগত বাধা পেলেন, এবং শেষ অবধি অনেকেই কক্ষত্যাগ করলেন, যেন সরকারি পক্ষের মত বাদে অন্য কোনও মতই শোনার অর্থ নেই। বিধানসভার ‘প্রোসিডিংস’ বা কার্যনির্ঘণ্ট থেকে কিছু অংশ কেটে বাদ দেওয়া হল। সভায় কথা বলতে গিয়ে বাধা পেলেন বিরোধী দলের বিধায়ক। লোকসভায় বিরোধীদের বাক্স্বাধীনতা খর্ব করা নিয়ে যাঁরা সর্বদাই সরব— এবং, যথাযথ কারণে সরব— তাঁরাই যদি নিজেদের শাসনাধীন রাজ্যে এ ভাবে বিরোধী পক্ষের কণ্ঠরোধ করতে উদ্যত হন, তবে তার মধ্যে এক বিপুল দ্বিচারিতা থাকে। ভবিষ্যতে তাঁরা ফের ভিন রাজ্যে গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তা নিতান্তই ফাঁপা শোনাবে না কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)