বাক্যগুলি ছিল এই রকম: “ঠিক যেমন ভারতে আছে ভারতীয় অতি-জাতীয়তাবাদীরা, চিনে আছে চিনা অতি-জাতীয়তাবাদীরা। এ এক এমন জাতীয়তাবাদের কাচ (‘লেন্স’) যা বাস্তবকে বিকৃত করে দেখায়। অথচ এই গোত্রের জাতীয়তাবাদের পক্ষে অনেক বেশি পরস্পরসংযুক্ত, পরস্পরনির্ভর হয়ে গিয়েছে আজকের দুনিয়া।” কথাগুলি উচ্চারিত হয়েছিল ১৯৬২ সালে, চিন-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষিতে। বলেছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ— প্রধানমন্ত্রী নেহরুর বিরোধী, পূর্বতন গান্ধীবাদী জাতীয়তাবাদী, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা, পরবর্তী কালে কংগ্রেস-বিরোধী জনতা পার্টির মুখ্য ব্যক্তিত্ব হওয়ার সুবাদে যিনি বিজেপির কাছে দেবমহিমান্বিত। চিন-ভারত যুদ্ধের আকস্মিকতা বড় ধাক্কা দিয়েছিল তৎকালীন সরকারপক্ষ বিরোধীপক্ষ সমেত সমগ্র দেশকে। সেই সময়ে ভারতের স্বার্থরক্ষার্থে কী কী পদক্ষেপ করা জরুরি, তার বিস্তারিত আলোচনা-সমেত ‘জে পি’ একটি বক্তৃতা দেন সর্বোদয় আন্দোলনের সভায়। সেখানে তিনি বলেছিলেন বিদেশি শক্তির সঙ্গে ক্ষমতাসঙ্কটের নিরসনে আলোচনা (‘আরবিট্রেশন’) এবং দ্বিপাক্ষিক কথোপকথন (‘বাইল্যাটারাল টকস’) জরুরি। প্রশ্ন তুলেছিলেন, “আর দেয়ার আদার পিসফুল ওয়েজ় অব সেটলিং ডিসপিউটস?” অন্য কোনও পথ কি আছে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে অশান্তি মেটানোর? যুযুধান দুই প্রতিবেশী দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যাতে ভুল বোঝাবুঝি কমে, সেই লক্ষ্যে ওই বছরের পয়লা মার্চ ‘ফ্রেন্ডশিপ মার্চ’ শুরু করেছিলেন তিনি ও তাঁর সহচারী নেতারা, নয়া দিল্লির মহাত্মা গান্ধী স্মারক মঞ্চ থেকে। কথোপকথনের কূটনীতি দিয়ে সব সঙ্কটের মীমাংসা সম্ভব নয়— যাঁরা এ যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁদের দিকে তীক্ষ্ণ প্রতিপ্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন জয়প্রকাশ: তবে কি জাতীয়তাবাদের স্লোগানে ও শত্রুতা প্রচারেই সমস্যার সমাধান নিশ্চিত? সামরিক ক্ষমতার উপর অত্যধিক নির্ভরতা দিয়ে কত দূর এগোনো যায়, গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। লক্ষণীয়, একটি অপ্রত্যাশিত কঠিন যুদ্ধের আবহেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী নেতাদের মধ্যে তর্কবিতর্কর পরিবেশটি মোটেই ক্ষুণ্ণ হয়নি।
প্রশ্ন, তর্ক বা সমালোচনার পরিবেশ ক্ষুণ্ণ হয়নি ২০০৮ সালের মুম্বই হামলার পরও। সে কথা জানেন তৎকালীন ভারতের বিরোধী রাজনীতিকরা, যাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। হামলার মাত্র দুই দিন পর, ২৮ নভেম্বর, ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে মুম্বইয়ে বিজেপির সমাবেশ আহূত হয়, সন্ত্রাসের প্রেক্ষিতে জনক্ষোভকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী দ্রুত মুম্বই চলে আসেন। দিল্লি ও রাজস্থানে ভোট তখন দোরগোড়ায়, ২৯ নভেম্বর ও ৪ ডিসেম্বর। বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে মুম্বই হামলার ছবি ব্যবহৃত হয়, ‘সন্ত্রাস হানা: দুর্বল সরকার, অনিচ্ছুক ও অক্ষম’ মর্মে। জাতীয় সঙ্কটের সময় এ ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণ করা উচিত কি না, সেই সংশয় সত্ত্বেও সমালোচনা ও আক্রমণের পরিবেশ তখনকার ভারতে বিরাজমান ছিল।
এত দিনে সেই ভারত দূর দিগন্তে অস্তমিত। ২০১৯ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা কাণ্ড ঘটার দুই সপ্তাহের মধ্যে কন্যাকুমারীর জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখে ধ্বনিত হয়— জাতীয় নিরাপত্তার সরকারি পদক্ষেপ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ দেশের সরকার তথা শাসকের বিরোধিতা। বলা হয় ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে ভারতীয় নাগরিকের মুখে ভারত সরকারের সমালোচনা পাকিস্তান কাজে লাগাবে। প্রশ্নধ্বংসী জাতীয়তার প্রচারে ক্রমে ঢাকা পড়ে যায় একটি সত্য যে, জাতীয় সার্বভৌমতা ও সন্ত্রাস-সঙ্কট বিষয়গুলির গুরুত্ব গণতান্ত্রিক দেশের সকল নাগরিকের কাছেই গগনচুম্বী, আর সেই জন্যই তৈরি হতে পারে সংশয়, জিজ্ঞাসা, আপত্তি ও সমালোচনা। প্রশ্নকারীকে শাসন-কর্তারা কথায় কথায় গ্রেফতার করলে, কিংবা বিচার-কর্তারা প্রশ্নকারীকে চুপ করিয়ে দিলে তাতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মান্য হয় না। অথচ ভারত-পাকিস্তান সমস্যা এত গভীর ও ব্যাপক যে আদৌ কোন পথে তার সমাধান কত দূর সম্ভব— তা নিয়ে সকলেই গভীর অজ্ঞানতায়। গত আট দশকে সমাধানের বহু প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে, তার মধ্যে বিশেষ স্মরণীয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর নামটি, যিনি বহুবিধ সঙ্কটের মধ্যেও দ্বিপাক্ষিক মৈত্রীর গুরুত্ব অনুধাবন করতে ভোলেননি। জাতীয়তাবাদ বা জাতীয়তাবোধ বিষয়টি যে একশৈলিক কিংবা একস্বরবিশিষ্ট হওয়া অসম্ভব, সেই কথাটি বিস্মৃত হওয়াতেই হয়তো জাতীয় স্বার্থের সর্বাধিক ক্ষতি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)