E-Paper

(বি)ভ্রান্ত

বাইরে থেকে কোনও বিষয় চাপিয়ে দেওয়া হলে তার উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে ধন্দ জাগবেই। এ ক্ষেত্রে আশঙ্কাটি দ্বিবিধ।

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৩

বিদ্যালয়গুলিতে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর শরীর-মনের বিকাশে খেলাধুলা, শারীরিক কসরত, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বিতর্কসভার চল রয়েছে। এই সব কিছুরই গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী, বিশেষত বিতর্কের— তথ্য, যুক্তির বিন্যাসে একটি মতের সমর্থন বা বিরোধিতা কী করে করতে হয়, তা কাজে লাগে ভবিষ্যৎ বৃহত্তর জীবনেও। স্কুলে বিতর্কের বিষয় কী হবে তা ঠিক করে দেবেন স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা প্রশাসকেরা নন— এটাই কাম্য, সঙ্গতও। কিন্তু দেশ জুড়ে জনজাতিভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য চারশোরও বেশি একলব্য মডেল রেসিডেনশিয়াল স্কুল (ইএমআরএস) চালায় যারা, ‘ন্যাশনাল এডুকেশন সোসাইটি ফর ট্রাইবাল স্টুডেন্টস’ (এনইএসটিএস) নামের সেই জাতীয় সংস্থাটি সম্প্রতি একলব্য স্কুলগুলিতে বিতর্কের বিষয় বেঁধে দিয়েছে, ‘আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ভারতের দেশীয় জ্ঞানতন্ত্রকে লঘু করছে’। এ মাসেই স্কুলে স্কুলে তা করতে হবে।

বাইরে থেকে কোনও বিষয় চাপিয়ে দেওয়া হলে তার উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে ধন্দ জাগবেই। এ ক্ষেত্রে আশঙ্কাটি দ্বিবিধ। এক, এখানে বিতর্কের বিষয় বেঁধে দিচ্ছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ নন, শিক্ষা প্রশাসকেরা— যাঁদের কাজ স্কুলব্যবস্থা কী রকম চলছে, তার পরিকাঠামো ও পঠনপাঠনের মানোন্নয়নে কী করণীয় এগুলি দেখা, বিতর্কের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো নয়। তাতে শিক্ষকদেরও অসম্মান করা হয়। দুই, যে বিষয়টি দেওয়া হল সেটিও গোলমেলে, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে এখানে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতের প্রাচীন তথা দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এনইএসটিএস-নির্ধারিত বিষয়টি আজকের ভারতশাসকদেরই সমর্থিত ও প্রচারিত মত— বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক বয়ানেরই অঙ্গাঙ্গি হল প্রাচীনের সঙ্গে আধুনিকের, দেশির সঙ্গে বিদেশির দ্বৈরথ তথা বনামতন্ত্রকে সামনে তুলে ধরা। বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা অহরহ আধুনিক শিক্ষা, বিশেষত বিজ্ঞানশিক্ষাকে অবজ্ঞা করেন এই বলে যে পৌরাণিক ভারতেই সব আছে: পুষ্পক রথ উড়োজাহাজের পূর্বসূরি, গণেশের হস্তিমুণ্ড প্লাস্টিক সার্জারির দৃষ্টান্ত। স্কুলের পাঠ্যবইগুলি এই সূত্র ধরেই ইতিহাসের বিকৃতি, বিজ্ঞানের নানা জরুরি ধারণার বিলোপ-রোগে আক্রান্ত। এতেই শেষ হচ্ছে না, স্কুলপড়ুয়াদের দিয়ে বিতর্কের নামে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড় করালে উগ্র জাতীয়তাবাদী হাতটি শক্ত হয় আরও।

আয়োজকেরা হয়তো বলবেন এ তো বিতর্ক, পক্ষে যেমন, বিপক্ষেও সমান মতপ্রতিষ্ঠা হবে। আজকের ভারতে ‘বিরুদ্ধ’ স্বর ও মতের উপর যে আঘাত, তা মাথায় রাখলে অবশ্য এ আশ্বাসে চিঁড়ে ভেজার নয়— আধুনিকতম বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিখর ছোঁয়া এই একুশ শতকে স্কুলে স্কুলে বিতর্কের ছলে প্রাচীনমুখিতাকে এগিয়ে বা জিতিয়ে দেওয়ার আশঙ্কাটা থেকেই যায়। তার থেকেও জরুরি কথা, এই বিতর্কে বলবে যারা, ভারতের নানা জনজাতি গোষ্ঠী থেকে আসা সেই ছাত্রছাত্রীদের সিংহভাগই আর্থ-সামাজিক ভাবে অত্যন্ত অনগ্রসর, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী— যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষা যাদের সবার আগে, সবচেয়ে বেশি দরকার। দেশীয় জ্ঞানতন্ত্রকে আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে লড়িয়ে দেওয়ার বীজটি এদের মনের মধ্যে না বুনে, এরা যাতে শিক্ষার সর্বৈব সুযোগ পায়, সেই অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education system National Education Society for Tribal Students debate

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy