রাহুল গান্ধীর মনে একটি সংশয় তৈরি হওয়া স্বাভাবিক— তিনি যাকে হাইড্রোজেন বোমা ভেবে ফাটাচ্ছেন, তাতে কালীপটকার অভিঘাতটুকুও তৈরি হয় না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর তাঁকে খুঁজতে হবে নিজের রাজনীতির চরিত্রের মধ্যেই। প্রথম দফায় যখন তিনি তথ্যপ্রমাণ-সহ ‘ভোট চুরি’র অভিযোগ পেশ করেছিলেন, দেশ জুড়ে খানিক হইচই পড়েছিল; নির্বাচন কমিশনও অনেক সক্রিয় ভঙ্গিতে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। আর এই শেষ দফায় যখন তিনি হরিয়ানায় ২৫ লক্ষ ভোট চুরির অভিযোগ করলেন, তা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অথচ, গুরুত্বের নিরিখে শেষ অভিযোগটি সম্ভবত প্রবলতর। তা হলে? কেউ বলতে পারেন, এখানে রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেসের একটি রণকৌশলগত ত্রুটি রয়েছে। প্রথম বারে যে অভিযোগ মানুষকে চমকে দিতে পারে, বারে বারে একই অভিযোগ উঠতে থাকলে তা ক্রমে ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠে, ফলে মানুষের মনোযোগও কম আকর্ষণ করে। বিশেষত, অভিযোগের দফার মধ্যে যদি মাসাধিক কালের ব্যবধান থাকে, তা হলে আগের অভিযোগের অভিঘাত তুলনায় অনেক কমে যায়— ফলে, নতুন অভিযোগটি সেই অভিঘাতের উপরে মাত্রা যোগ করতে পারে না, তার নতুন এবং তুলনায় ক্ষীণতর অভিঘাত তৈরি হয়। দ্বিতীয় গোলমালটি— বিপণনের পরিভাষায়— রাহুলের রাজনৈতিক বার্তার গঠনে নিহিত। তিনি যে অভিযোগ জনসমক্ষে আনছেন, তা তথ্যবহুল, গণনানির্ভর। কোনও রাজনৈতিক বার্তা এত ভারী হলে সচরাচর সাধারণ মানুষের মধ্যে তার সঞ্চার তুলনায় কম হয়। বার্তাটিকে বাঁধা উচিত ছিল এমন তারে, যা মানুষের মাথায় সহজে গেঁথে যাবে, এবং যার পুনরাবৃত্তি করা সহজ। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি যে প্রচারকৌশল গ্রহণ করেছিল, রাহুল তার দু’এক পাতা উল্টে দেখতে পারেন।
অনুমান করা চলে, তিনি বিহার নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই ‘হাইড্রোজেন বোমা’টি এই সময়ে ফাটালেন। কিন্তু, যে অনভিপ্রেত বিপরীতমুখী বার্তাটির কথা তিনি বিস্মৃত হলেন, তা হল, সাধারণ ভোটারের মনে হতেই পারে যে, এই রাজ্যের নির্বাচনেও তাঁদের সম্ভাব্য পরাজয়ের কথা মাথায় রেখে রাহুল অজুহাত সাজাচ্ছেন। নির্বাচনের ফল জানতে আরও দু’এক দিনের অপেক্ষা। কিন্তু, ভোট দিতে যাওয়ার আগেই যদি ভোটারের মনে হয় যে, দল ইতিমধ্যেই পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে, তবে তাতে সেই দলকে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা কী ভাবে প্রভাবিত হতে পারে, রাহুল গান্ধী সম্ভবত ভাবেননি। কিন্তু, বিহারে তাঁর ‘এই আছি এই নেই’ উপস্থিতি নিয়ে দলের অন্দরেই যে প্রশ্ন উঠেছে, সেটিও কি তাঁর অজানা? ভোটারের মনে দু’টি বিষয় মিললে তাঁর সম্বন্ধে যে ধারণাটি তৈরি হতে পারে, নির্বাচনী রাজনীতিতে তা সুসংবাদ নয়। সাত-পাঁচ বিবেচনা না করে কোনও কাজ করে বসা রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক নয়।
তবে, রাহুলের রাজনীতিতে ভোট চুরির অভিযোগের যে প্রভাবই পড়ুক না কেন, এক জন নাগরিক হিসাবে তিনি যেখানে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ-সহ অভিযোগ পেশ করছেন, তখন নির্বাচন কমিশনের কর্তব্য ছিল সেই অভিযোগকে যথাবিধি গুরুত্ব দেওয়া। তার বদলে কমিশন প্রথম দফায় আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে রাহুলের উপরেই কার্যত অভিযোগ প্রমাণের দায় চাপিয়েছিল; আর এই দফায় তাদের নীরবতা কর্ণবিদারক। মুখ্য নির্বাচন কমিশনারকে স্মরণে রাখতে হবে যে, রাজনৈতিক কর্তারা যতই চান না কেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বায়ত্তশাসিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান— গণতন্ত্রে তার তুল্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আর নেই। শুধু তার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়— গণতন্ত্রের স্বার্থেই নিশ্চিত করতে হবে যে, প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা বিষয়ে দেশবাসীর মনে যেন তিলমাত্র সন্দেহও না থাকে। কমিশনের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না যে, তারা সেই গুরু কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)