বেকায়দায় পড়লেই কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম সাধারণত কামান দাগার পথটি বেছে নেন। তিনি যেমন হুঙ্কার দেন— সমস্ত বেআইনি নির্মাণ ভেঙে ফেলা হবে, একটি জলাশয়ও তিনি বোজাতে দেবেন না, ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ঘোষণাগুলি অন্তঃসারশূন্য, তদর্থে লক্ষ্যভেদে অক্ষম। অনিয়ম তার নিজ স্থানেই বহাল থাকে। সম্প্রতি মেছুয়ার এক হোটেলে মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে ১৪ জনের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জানিয়েছিলেন, কলকাতার সমস্ত রুফটপ ক্যাফে, লাউঞ্জ, পানশালা বন্ধ করা হবে। উঁচু বাড়ির ছাদ সর্বজন ব্যবহারযোগ্য হিসাবে চিহ্নিত করে সেখানে সমস্ত নির্মাণ ভেঙে ফেলা হবে। সেইমতো চিহ্নিতকরণের কাজও শুরু হয়েছিল। তবে সেই অতি-তৎপরতায় দু’সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। পুরসভাকে নির্দেশ দিয়েছে, পুনরায় এমন পদক্ষেপ করার আগে প্রামাণ্য তথ্যগুলি আরও এক বার খুঁটিয়ে দেখতে। জানিয়েছে, কোনও পক্ষ আইন ভঙ্গ করলে প্রতিষ্ঠিত আইনি পথে ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু নিয়মবহির্ভুত বা হঠকারী পদক্ষেপ চলবে না।
কথাগুলি গুরুত্বপূর্ণ। অগ্নিকাণ্ডের পর পুরপ্রশাসন সদর্থক ব্যবস্থা করবে, স্বাভাবিক। কিন্তু, এত কাল ধরে রুফটপ রেস্তরাঁ, পানশালাকে ছাড়পত্র দেওয়ার পর হঠাৎ সমস্ত বন্ধ করার নির্দেশের পিছনের যুক্তিটি বোঝা মুশকিল। যাঁরা নিয়ম মেনে ব্যবসা করছেন, তাঁরা এই খামখেয়ালিপনার শিকার হবেন কেন? তা ছাড়া উঁচু বাড়িতে খোলা ছাদের প্রয়োজন কতখানি, স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করে দিয়েছিল। ছাদের দরজা বন্ধ থাকায় অনেকের মৃত্যু ঘটেছিল ছাদে ওঠার সিঁড়িতেই। অথচ, সেই প্রয়োজন বুঝতে পুরসভার পনেরো বছর লেগে গেল? শহরে ছাদ-রেস্তরাঁর সংখ্যা কত, সে বিষয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও সংখ্যাটি নেহাত কম নয়। পুরসভা ও দমকলকে কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে— ৮৩। দমকল সূত্রে জানা গিয়েছে সংখ্যাটি ৫০০-রও বেশি। তবে কি নির্মাণগুলির এক বৃহদংশই হয়েছিল পুরসভার অজানতে, বেআইনি পথে? সে দায় কি পুরসভারই নয়? সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডগুলিতে অপরিসর স্থানে বেআইনি নির্মাণকাজ, বিদ্যুৎবাহী তারের জঞ্জাল, বিকল্প পথ না থাকা, ত্রুটিপূর্ণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, সর্বোপরি পুরসভার নজরদারির অভাবের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। সেই ত্রুটিই বা পুরসভা ঢাকবে কোন পথে?
কামান দাগার কাজটি সহজ। তাতে ভোটপ্রাক্কালে ‘কড়া প্রশাসক’-এর ভাবমূর্তি তুলে ধরা যায়, প্রশাসনের অন্দরের দুর্নীতিজালও আড়াল করা যায়। কিন্তু নগরের স্বাস্থ্য ফেরে না। সভ্য দেশে নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আইন থাকে। সেই আইন নাগরিকের পাশাপাশি প্রশাসনকেও মেনে চলতে হয় নাগরিক সুরক্ষার স্বার্থে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, কলকাতা এবং বৃহদর্থে গোটা রাজ্যে এই আইন মানার মনোভাব গত কয়েক বছরে সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গিয়েছে। নাগরিক জানেন, কাঞ্চনমূল্যে সব বেআইনি কার্যকলাপে ছাড় পাওয়া যায়। প্রশাসন জানে, বিপর্যয় ঘটলে শ্রুতিমধুর ভাষণে, রঙিন প্রতিশ্রুতিতে, নিদেনপক্ষে জনগণের অ-সচেতনতার দোহাই দিয়ে সব দায় ঝেড়ে ফেলা যায়। এই স্বার্থসর্বস্ব মানসিকতার ফাঁদে নাগরিক জীবন সুতোয় ঝোলে। অপেক্ষা করে পরবর্তী বিপর্যয়ের, অকালমৃত্যুকে বরণ করার।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)