E-Paper

বিদ্বেষবিষাক্ত

মূল কথাটি হল, সরকারকে সংখ্যালঘু-তোষণকারী, সুতরাং হিন্দুবিরোধী প্রমাণ করতেই বিজেপি নেতারা এখন অতি সরব ও সক্রিয়।

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:২৩

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা ব্যাট হাঁকিয়ে ধর্মীয় বিভাজনের ‘লাইন’-এ খেলছেন। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যে আক্রমণ শাণিয়ে শুভেন্দু অধিকারী বিধানসভা থেকে নিলম্বিত হলেন, তাতে ধর্মীয় বিভাজনের উত্তাপ আরও অনেকটা চড়ল। আপাতত তাঁর রাজনীতির গৈরিক ঝোলাটি সাফল্যের প্রাপ্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। সাসপেনশনের পর তাঁর বার্তা— সরস্বতী পুজোয় বাধাদানের ঘটনার আলোচনা চেয়েছিলেন বলেই স্পিকারের এই সিদ্ধান্ত, উল্টো দিকে স্পিকারের বক্তব্য, বিধায়কদের কাগজ ছিঁড়ে অশান্তি তৈরি করা এবং ক্ষমা চাইতে আপত্তির জন্যই এই ঘটনা ঘটল। মূল কথাটি হল, সরকারকে সংখ্যালঘু-তোষণকারী, সুতরাং হিন্দুবিরোধী প্রমাণ করতেই বিজেপি নেতারা এখন অতি সরব ও সক্রিয়। এক দিকে বিধানসভা নির্বাচনের সলতে পাকানো শুরু, অন্য দিকে প্রতিবেশী বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইসলামি কট্টরপন্থীদের সংখ্যালঘু বিরোধিতা ও ভারতবিরোধী প্রচার প্রত্যহ তুঙ্গচুম্বী— এই তো প্রকৃষ্ট সুযোগ গৈরিক আলোক প্রক্ষেপণে মঞ্চ মাতিয়ে তোলার। ২০২১ সাল থেকে লাগাতার মুসলমানবিরোধী প্রচারে নিজের ‘কৃতবিদ্যতা’ প্রমাণ করেছেন বিরোধী নেতা। তা ছাড়া রাজ্যের তৃণমূল সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু-তোষণের অভিযোগ অনেক দিনের, ভোটের বাজারে তা যথেষ্ট পরীক্ষিতও বটে। ফলে এ বার তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘মোল্লার সরকার’ ধুয়ো তুলতে তাঁরা ঝাঁপ দিয়েছেন এই অনুমান নিয়ে যে অভিযোগটি মুখ্যমন্ত্রী উপেক্ষা করলেও বিজেপির লাভ, আবার আত্মপক্ষ সমর্থন করলেও বিজেপি রাজনীতির স্বীকৃতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয় কাজটিই করেছেন। নিজেকে ‘হিন্দু ব্রাহ্মণ’ বলে ঘোষণা করে ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে এনেছেন। রাহুল গান্ধীও ২০১৮ সালে বিজেপির লাগাতার প্রচারের সামনে নিজের পৈতে-সম্বলিত হিন্দু পরিচিতি নিয়ে এই ভাবেই প্রচার করেছিলেন। তাতে তাঁর রাজনৈতিক লাভ হয়েছিল না ক্ষতি, সে তথ্য ভারতের অজানা নয়।

তবে শাসক, বিরোধী কার কত লাভ বা ক্ষতি, ইত্যাদির থেকেও অনেক বড় বিষয় এই ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের লাভ-ক্ষতির প্রশ্নটি। ধর্ম নিয়ে বিভেদ-রাজনীতিই এই রাজ্যের নেতানেত্রীরা সবচেয়ে আকর্ষণীয় পথ হিসেবে বেছে নিলেন, যখন কালান্তক দেশভাগের দুই প্রজন্ম পরেও তার ঘা শুকোয়নি, আজও প্রত্যহ অগোচরে দুই বাংলার মধ্যে সীমান্তরেখা অগণিত মানুষের ক্লেশ ও যন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠছে। সীমান্তের দুই দিকেই সংখ্যালঘু মানুষ মানসিক, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের শিকার। তবু তার উপরেই ভর দিয়ে রাজনৈতিক লাভের লোভ করেন এই নেতারা, এবং ভোটের বাজারে সেই লাভের অঙ্ক বাড়াতেই উন্মুখ হন। গত দেড় দশকে বিজেপি-আরএসএস’এর যৌথ উদ্যোগে এবং অন্যান্য দলের সীমিত বাধাদানের সুযোগে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মধ্যে নতুন করে অবিশ্বাসের বাস্তব তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের ঘটনাবলি সেই অবিশ্বাস ও ঘৃণা বাড়িয়েছে। সীমান্তে বসবাসকারী সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চলছে। বিভেদকামী নেতারা নিশ্চয়ই মহাখুশি, এই ছিন্নভিন্ন সমাজই তাঁদের লুব্ধ লালায়িত ক্ষমতা-আরাধনার পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী, সর্বাধিক প্রতিশ্রুতিময়। অথচ এই বাংলার বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতাই বার বার ভিন্ন পথের সন্ধান দিয়ে গিয়েছেন। সম্প্রদায়ভেদ, সমাজভেদ সবই বাস্তব, ক্ষেত্রবিশেষে দুই পক্ষেই সঙ্কীর্ণতার আস্ফালনও থামানো যায় না, তজ্জনিত সংঘর্ষও পুরোপুরি নিঃশেষ করা অসম্ভব। কিন্তু সেই নেতারা বলেছিলেন যে তবু ধর্মভিত্তিক বিদ্বেষ ও সংঘর্ষের পরিবেশকে সুস্থ রাজনীতির দিকে ফিরিয়ে আনা যায়, যদি রাজনীতি জাতধর্মশ্রেণিলিঙ্গভাষা নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করাকে ‘পাখির চোখ’ করে চলে। বঙ্গীয় রাজনীতির কলাকুশলীরা নিশ্চয় বলবেন, সে পথে ভোট আনা যায় না, মানুষের সম্মান, নিরাপত্তা ইত্যাদির চেয়ে মানুষের ভোট দামি, তাই নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে...!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Suvendu Adhikari BJP

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy