E-Paper

হৃদয়ের ভাষা

গণতান্ত্রিক দেশে শাস্তির খাঁড়া ঝুলিয়ে কোনও ভাষাকে ‘ভালবাসতে’ বাধ্য করা সেই ভাষার পক্ষেও সম্মানের নয়। হরফের আকারের মাপ বেঁধে দিয়ে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বজায় রাখার মধ্যে যে অবিবেচনা আছে, মাননীয় মহানাগরিক সে বিষয়ে সচেতন হলে উপকার হয়।

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:২৯

শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামফলকে বাংলা বাধ্যতামূলক করার নিয়ম করেছে কলকাতা পুরসভা। মেয়র স্পষ্ট করেছেন, নামফলকে সবার উপরে বাংলায় নাম লিখতে হবে, এবং সেই হরফের আয়তন যেন কোনও ভাবেই অন্য ভাষার হরফের চেয়ে ছোট না হয়। এর আগেও বার বার কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন শহরে সাইনবোর্ডে বাংলা বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ দিতে দেখা গিয়েছে সংশ্লিষ্ট পুর কর্তৃপক্ষকে। তবে, সেই নির্দেশিকা যে সর্বাঙ্গীণ সাফল্য লাভ করেছিল, তা বলা যায় না। কারণ, সফল হলে, পুরসভাকে বিষয়টি নিয়ে আবার এতখানি চিন্তিত হতে হত না। তবে, এ বারের নির্দেশিকার প্রেক্ষিত কিছু ভিন্ন। ভিন রাজ্যে বাংলাভাষী গরিব পরিযায়ীদের নিপীড়নের প্রতিবাদে বাঙালি অস্মিতার যে প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরির চেষ্টা চলছে, এ তারই অংশ।

রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষ বাংলাভাষী, অতএব তাঁদের পক্ষে সহজে বোঝার স্বার্থেই নামলিপিগুলিতে বাংলা হরফের গুরুত্বপ্রাপ্তি জরুরি। চেনা লিপি দেখে মানুষ আত্মিক যোগ অনুভব করলে প্রতিষ্ঠানেরও লাভ। তবে, বাংলার মানরক্ষায় প্রশাসনের তরফে এমন জোরজবরদস্তিও যে অনভিপ্রেত, তার উদাহরণ দেশের অনেক রাজ্যেই রয়েছে। কর্নাটক জুড়ে নামফলকে কন্নড় লিপির আধিপত্যের পিছনে রয়েছে সে রাজ্যের কঠোর আইন। মহারাষ্ট্রেও শিবসেনা কর্তৃক মরাঠি ভাষা ফলকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আইনি প্রয়োগে। এ ভাবে একটি ভাষার আগ্রাসনের বিরোধিতায় রাষ্ট্রশক্তি-পুষ্ট অন্য একটি ভাষাকে আরোপ করা, ভাষার অস্ত্র নিয়েই যুযুধান হয়ে পরিস্থিতি জটিল এবং পরিবেশকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বোধ্য করার চেয়ে সহজ সমাধান হল— আন্তরিক ভাবে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটির প্রতি আস্থা রেখে আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সম্যক শ্রদ্ধা প্রদর্শন। প্রশাসন জনতাকে সেই রাস্তায় বিলক্ষণ উদ্বুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু, গণতান্ত্রিক দেশে শাস্তির খাঁড়া ঝুলিয়ে কোনও ভাষাকে ‘ভালবাসতে’ বাধ্য করা সেই ভাষার পক্ষেও সম্মানের নয়। হরফের আকারের মাপ বেঁধে দিয়ে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বজায় রাখার মধ্যে যে অবিবেচনা আছে, মাননীয় মহানাগরিক সে বিষয়ে সচেতন হলে উপকার হয়।

মাতৃভাষার প্রতি এই শ্রদ্ধা সমাজের হৃদয় থেকেই উৎসারিত হওয়া জরুরি। কী ভাবে, পথ দেখিয়েছিলেন বাংলার সাহিত্যিকরা। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সক্রিয়তা, নামফলকে বাংলা বাধ্যতামূলক করার দাবিতে তাঁর ও বিদগ্ধমহলের রাস্তায় নেমে মিছিলের পর নাগরিক সমাজ অনুপ্রাণিত হলেও সেই আলোড়নের অভিঘাত বৃহত্তর জনপরিসরে পৌঁছনোর আগেই কালের গর্ভে বিলীন হয়েছিল। গত কয়েক দশকে বাংলা ভাষার পক্ষে অর্থনীতির জোর ক্রমেই কমেছে। তার একটি বড় কারণ হল, বাংলা এখন আর যথেষ্ট ‘কাজের ভাষা’ হিসাবে গণ্য হয় না সমাজের একটি বড় অংশের কাছে— উচ্চবিত্তদের কাছেও নয়, খেটে খাওয়া মানুষের কাছেও নয়। অর্থনীতির সেই হৃত গৌরবটি ফিরিয়ে আনলে বাংলা ভাষাও ফের তার সামাজিক জোর ফিরে পাবে। পাশাপাশি, এই ভাষার জন্য এখনও যত মানুষের হৃদয়ে অকৃত্রিম ভালবাসা রয়েছে, এই শহর, এই রাজ্য জুড়ে বাংলার বহুল ব্যবহারের জন্য সামাজিক স্তরে তাঁদের আরও সরব হতে হবে। মানুষের ভাষা মানুষের জোরেই ভাস্বর হোক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali KMC

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy