E-Paper

প্রহসনে পর্যবসিত

কোনও বিপর্যয় ঘটলেই ফস্কা গেরোকে কী করে বজ্র আঁটুনিতে পরিণত করা হবে, তার নানা পরিকল্পনা ঘোষণা করে স্বাস্থ্য দফতর। কয়েক দিন কড়াকড়ির দেখনদারি চলে। অতঃপর নিরাপত্তা ফের শিথিল হতে থাকে, ঢুকে পড়ে বেনোজল।

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ০৪:৫৭

পশ্চিমবঙ্গের সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে আর কত বার হতাশ্বাস হতে হবে, রাজ্যবাসীর এখন এটাই প্রশ্ন। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া-চিকিৎসক হত্যা, কসবার আইন কলেজে ছাত্রী ধর্ষণের পর এসএসকেএম-এ নাবালিকা নিগ্রহের ঘটনা— সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক শিথিলতার সুযোগে অনায়াসে ঘটিয়ে ফেলা যাচ্ছে ভয়ঙ্কর অপরাধ। কর্তৃত্বের মোড়ক ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের যে কোনও জায়গায় প্রবেশ করতে পারছে দুর্বৃত্তরা, ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার করতে পারছে তারা। প্রথম প্রশ্নই ওঠে ইউনিফর্মের অপব্যবহার নিয়ে। নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম নিরাপত্তারক্ষী অথবা চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মীর পরিচয়, যা রোগী এবং তার আত্মীয়দের মনে আস্থা তৈরি করবে। অথচ, বাজারে এই ইউনিফর্ম যথেচ্ছ বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে কি স্বাস্থ্য দফতর অন্ধকারে ছিল? এই মুহূর্তে কলকাতার প্রধান হাসপাতালগুলোয় নজরদারি দল পাঠানো হলে এমন অনেক ইউনিফর্ম-ধারী দুর্বৃত্ত ধরা পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? দ্বিতীয় প্রশ্ন, কাদের হাতে সরকার দিচ্ছে নাগরিকের নিরাপত্তা? এক হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী এতই বেপরোয়া যে, সে চিকিৎসকদের ইউনিফর্ম ব্যবহার করে অন্য হাসপাতালে যথেচ্ছ প্রবেশ করছে? কসবা আইন কলেজে এক ছাত্রীর ধর্ষণেও অন্যতম অভিযুক্ত নিরাপত্তারক্ষী। আর জি কর কাণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে এক নিরাপত্তারক্ষী। ব্লক হাসপাতাল এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে মহিলা চিকিৎসক ও নার্সদের হেনস্থা প্রায় ধারাবাহিক। বীরভূমের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এক নার্সের মাথায় বাইশটি সেলাই করতে হল দুষ্কৃতীর আক্রমণে।

কোনও বিপর্যয় ঘটলেই ফস্কা গেরোকে কী করে বজ্র আঁটুনিতে পরিণত করা হবে, তার নানা পরিকল্পনা ঘোষণা করে স্বাস্থ্য দফতর। কয়েক দিন কড়াকড়ির দেখনদারি চলে। অতঃপর নিরাপত্তা ফের শিথিল হতে থাকে, ঢুকে পড়ে বেনোজল। সিসিটিভি-সহ নানা প্রযুক্তির প্রয়োগ, ভবনে ভবনে রক্ষী নিয়োগ সত্ত্বেও দেখা গেল, প্রবেশকারীর ইউনিফর্মের রংটুকুই দেখা হয়। কোনও বিভাগে প্রবেশের আগে অপরিচিতের পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে দেখছেন না কোনও দ্বাররক্ষী। ট্রমা কেয়ার সেন্টার-এ প্রবেশ করা যদি এত সহজ হয়, তবে রোগীর নিরাপত্তা কতটুকু? বাজার থেকে কেনা ইউনিফর্ম পরে বহিরাগত দুষ্কৃতী অনায়াসে যে কোনও চিকিৎসাপ্রার্থী, কিংবা চিকিৎসাধীন রোগীর ক্ষতি করে দিয়ে যেতে পারে: অভাবনীয়। এই ফাঁক যে কেবল কর্তৃপক্ষের অন্যমনস্কতায়, কর্তব্যে অবহেলার জন্য ঘটছে, এমন নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারী নিগ্রহের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীচক্রের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। হাসপাতালের নানা সম্পদ পাচার, ছাত্র-ভর্তি বা পরীক্ষায় পাশের জন্য উৎকোচ গ্রহণ, হাসপাতালের শয্যা ও চিকিৎসার দালালি, এমন নানা ধরনের চক্র অবাধে চলছে হাসপাতালে। কর্মক্ষেত্রে এমন একটি দূষিত পরিবেশ তৈরি হয়েছে যাতে প্রশাসনিক বিধিনিয়মকে নিয়মিত লঙ্ঘন করতে পারছে কিছু দুষ্কৃতী। তারাই দুর্নীতির চক্রগুলি চালানোর ঠিকা নিয়েছে।

সম্বৎসর বিধি লঙ্ঘনের অভ্যাস যাদের, তারা যে নিজেদের আইনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলেই মনে করবে, এতে আর আশ্চর্য কী। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেয়েদের নিগ্রহ যে এক গুরুতর অপরাধ, সে বোধ তাদের কাছে আশা করাই মূর্খামি। এসএসকেএম কাণ্ডে ‘পকসো’-য় অভিযুক্ত অমিত মল্লিকের নামে এর আগেও নারী নিগ্রহের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, যার জন্য অতীতে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। এমন ব্যক্তিকে কী করে ফের নিরাপত্তারক্ষীর কাজে নিয়োগ করা হল, সে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। ঠিক যেমন নানা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের মামলা থাকা সত্ত্বেও কসবা আইন কলেজের মূল অভিযুক্ত শিক্ষাকর্মীর পদে নিযুক্ত হয়েছিল কী করে? মহিলাদের অপমান, যন্ত্রণার মূল্যে এই দুর্নীতি-দূষিত পরিস্থিতি বার বার রাজ্যকে হেঁটমস্তক করে দিচ্ছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Government Infrastructure Safety

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy