এই ভারতে ‘পুশব্যাক’ শব্দটি আপাতত নতুন গুরুত্বে মণ্ডিত। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে ও অসম প্রদেশের সরকারের তত্ত্বাবধানে, সে রাজ্যের অবৈধ অভিবাসীদের বলপূর্বক সীমান্ত পার করে দেওয়ার প্রক্রিয়া বা পুশব্যাক-কে কেন্দ্র করে সাংবিধানিক রীতিনীতি ভঙ্গের একাধিক প্রশ্ন উঠেছে। অবশ্য সর্বাগ্রে স্পষ্ট করা দরকার অবৈধ অভিবাসন ও পুশব্যাক নীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত সংখ্যালঘু-বিরোধিতার বিষয়টিও। পহেলগাম সঙ্কটের পর ভারত সরকার জঙ্গিদের বিষয়ে, এবং সেই সূত্রে অবৈধ মুসলমান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নতুন উদ্যমে তদন্ত ও সক্রিয় প্রতিরোধ তৈরি করতে চাইছে বলেই পূর্ব সীমান্তের এই পুশব্যাক। বুঝতে অসুবিধা নেই, নাগরিকত্ব পরীক্ষা ও সংখ্যালঘু বিরোধিতা— দু’টি প্রক্রিয়া এই ভাবে মিলে যাওয়ার ফলে পরিস্থিতি দ্রুত বিস্ফোরক হয়ে উঠছে। সংখ্যালঘু বিরোধিতার বিষয়টি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে বিরাট উত্তেজনা তৈরি করেছে, তার উপর পুশব্যাকের ফলে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের বাংলাদেশ প্রবেশ করতে দেয়নি, কিছু কিছু জায়গায় এঁদের ঘিরে প্রবল হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটেছে। অবস্থা এতটাই জটিল যে, অনেক মানুষকে পুনর্বার সীমান্ত পার করে ভারতের দিকে ফিরিয়ে আনাও হয়েছে। পুশব্যাক বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আগেই আলোচনা করা উচিত ছিল, কিন্তু সেই কূটনৈতিক পদক্ষেপটিকে সম্ভবত পরিহার করা হয়েছিল রাজনৈতিক তাড়নাতেই। যাঁদের পার করানো হচ্ছিল, তাদের মধ্যে আছে সদ্যোজাত শিশু, আছেন এমন মানুষও যাঁদের নাগরিকত্ব প্রশ্ন এখনও সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন। ফলে, বললে ভুল হবে না যে অবৈধ অভিবাসনের সঙ্কট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার মানবাধিকার দলনে উদ্যত।
অবৈধ পারাপার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটি দৈনন্দিন ঘটনা— অসম, ত্রিপুরার মতো পশ্চিমবঙ্গও তার ভুক্তভোগী। এ কথাও যথেষ্ট আলোচিত যে দেশভাগের পর এই সঙ্কট আটকাতে ভারতীয় রাষ্ট্র বিপুল ভাবে ব্যর্থ। সীমান্তের ছিদ্রপথ এতখানি খোলা যে, দুই দেশেই পারাপার ধারণাটি কোনও কালে অবাস্তব বা দুরূহ বলে প্রতীত হয়নি। সুতরাং, এই ছিদ্রান্বিত সীমান্তের দায়টি কেবল সমাজের নয়, মানুষের নয়— রাষ্ট্রেরও। মানুষ যে পারাপার করতে পেরেছেন, তার জন্য কেবল তাঁদেরই দায়ী করা চলে না— যে রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রপ্রতিনিধিরা এই পারাপার দশকের পর দশক ধরে সম্ভব করে তুলেছেন, তাঁদেরও এর দায় নিতে হবে বইকি। এমতাবস্থায়, যদৃচ্ছ ভাবে মানুষকে ধরে ধরে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’-এ পাঠিয়ে দেওয়ার মধ্যে নির্মমতা তো আছেই, মানবাধিকার হরণও আছে। এই মর্মে সম্প্রতি বহু সচেতন নাগরিক একত্রে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারকে, যাঁদের মধ্যে আছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সমাজকর্মী, আইনবিদ, শিক্ষক-অধ্যাপকরা। ‘পুশব্যাক’ কোনও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া হতে পারে না— চিঠির মূল বক্তব্য সেটাই।
সাংবিধানিক নীতি বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যদি বা পরিত্যাজ্য বলেও সিদ্ধান্ত করেন আজকের দেশশাসকরা, যদি রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার প্রশ্নটিকেও উপেক্ষা করতে চান, কূটনৈতিক বিবেচনাকেও কি তাঁরা বিসর্জন দেওয়ার পক্ষে? এমনিতেই পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বৈরথে আজ ভারত খানিক বিপন্ন, সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জে সন্ত্রাসবিরোধিতার কমিটিতে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি কিংবা চিন-তুরস্কের প্রকট ও অবারিত পাকিস্তান সমর্থন তার প্রমাণ। এর মধ্যে আবারও আন্তর্জাতিক রীতি ভঙ্গ করে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নতুন দ্বৈরথে জড়িয়ে পড়া কি সঙ্গত? অধুনা ঢাকার ক্ষমতামহল যে পাকিস্তান ও চিন উভয়েরই ঘনিষ্ঠ, সে কথা সর্ববিদিত। তাই হঠকারিতা ছেড়ে সুবিবেচনা ও কৌশলী পদক্ষেপ কাম্য। এক সঙ্কটের মীমাংসা করতে গিয়ে অন্য সঙ্কটে নিমজ্জিত হওয়া উত্তম রাজনীতি নয়, কূটনীতি তো নয়ই।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)