পঞ্চান্ন হাজার ভোটে পরাজিত হলেন লাল্লু সিংহ, জিতলেন অবধেশ প্রসাদ। নাম দু’টি দেখে কোনও সংযোগের কথা স্মরণে না আসাই স্বাভাবিক। তবুও এই মুহূর্তে সম্পাদকীয় নিবন্ধে তাঁদের নাম উঠে আসছে, কারণ উত্তরপ্রদেশের যে কেন্দ্রে বিজেপির লাল্লু সিংহকে হারিয়ে সমাজবাদী পার্টির অবধেশ প্রসাদ জয়ী হলেন, তার নাম ফৈজ়াবাদ। অযোধ্যা অঞ্চলটি এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। যে অযোধ্যার রামমন্দির গত তিন দশক ধরে বিজেপির রাজনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তির ভূমিকা পালন করেছে, সেখানেই পরাজিত হল বিজেপি, এই সংবাদটি তাৎপর্যপূর্ণ। ঠিক যেমন তাৎপর্যপূর্ণ আর একটি জয়সংবাদ— বারাণসী আসনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জয়ী হলেন ১,৫২,৫১৩ ভোটে। যাঁকে হারালেন, কংগ্রেসের সেই প্রার্থী অজয় রাই প্রধানমন্ত্রীর তুলনায় রাজনৈতিক ওজনে মনে ছটাকমাত্র নন। অনুমান ছিল, এ-হেন প্রতিদ্বন্দ্বীকে হেলায় উড়িয়ে দেবেন শ্রীমোদী, রেকর্ড ভোটে জয়ী হবেন। তা হয়নি। বারাণসীতে যত ভোট পড়েছে, তার ৫৪.২৪% পেয়েছেন তিনি। পাটিগণিতের অঙ্কে তিনি নিশ্চিত ভাবে জয়ী— কিন্তু, প্রধানমন্ত্রীও সম্ভবত জানেন যে, এমন জয় পরাজয়ের মতোই ম্লান। প্রথম দিকের ভোটগণনায় যে আসনে প্রধানমন্ত্রী পিছিয়ে পড়ছিলেন তাঁর এই অকিঞ্চিৎকর প্রতিদ্বন্দ্বীর থেকে, সেই বারাণসীকে হিন্দুত্বের রাজনীতির মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করতে কোনও কসুর করেননি তিনি। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সংস্কার করে সেখানে পূজায় বসেছেন, বারাণসীর গঙ্গায় ডুব দিয়ে প্রকাশ্যে কেঁদেছেন। কাশীতে তৈরি হয়েছে নমো ঘাট— মন্দিরের অতি নিকটে। এবং, মন্দিরসংলগ্ন জ্ঞানবাপী মসজিদ এখন বিজেপির রাজনীতিতে ‘পরবর্তী বাবরি মসজিদ’ হিসাবে চিহ্নিত। উত্তরপ্রদেশের যে দু’টি কেন্দ্রে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির দুই প্রবল প্রতীকের অবস্থান, সে দু’টি কেন্দ্রেই বিজেপির এমন কাঁপুনি কিসের ইঙ্গিত বহন করে?
গোটা উত্তরপ্রদেশেই বিজেপি-বিরোধী হাওয়া প্রবল। কিন্তু, ফৈজ়াবাদ ও বারাণসীর ফলাফলের গুরুত্ব তার চেয়েও খানিক অধিক। অনুমান করা চলে, বিভাজনের রাজনীতির প্রতীক হিসাবে ক্রমাগত ব্যবহৃত হয়ে চলা সেই কেন্দ্রগুলির ভোটারদের একটি বড় অংশকে বিচলিত করেছে, অধৈর্যও করেছে। মন্দির তৈরি করা এক কথা, মসজিদ ভেঙে তার জায়গা দখল করে মন্দির তৈরি করা আর এক— সেই কার্যক্রমে সব হিন্দুরই সমান সমর্থন থাকবে, এ কথা ভেবে নেওয়া চলে না। এখানে উত্তরপ্রদেশ নামক রাজ্যটির রাজনৈতিক চরিত্র বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ রাজ্যের জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত প্রায় কুড়ি শতাংশ, এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ক্ষেত্র হিসাবে ক্রমাগত ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও অন্য একাধিক রাজ্যের মতো এই রাজ্যের রাজনৈতিক বোধ শুধুমাত্র ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না। এমনকি, বারাণসীর মতো প্রকৃতার্থে একটি বহুধর্মাবলম্বী শহরকে শুধুমাত্র হিন্দুদের আধিপত্যের পরিসর হিসাবে চিহ্নিত করার মধ্যে যে গা-জোয়ারি আছে, অঞ্চলের নাগরিকদের একাংশ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অনস্বীকার্য যে, তা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদী জয়ী, কেন্দ্রে বিজেপিই সরকার গঠন করার জন্য প্রথম ডাক পাবে। প্রশ্ন হল, মানুষের এই বার্তাটি তাঁরা স্মরণে রাখবেন কি? তাঁরা এই বার স্বীকার করবেন কি যে, বিভাজনের রাজনীতির একটি সীমা থাকে, যাকে অতিক্রম করলে গণদেবতা রুষ্ট হন?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)