Advertisement
E-Paper

অবিশ্বাস্য

দুর্নীতির যে পাহাড় রাজ্যে গড়ে উঠেছে, তার শীর্ষে আরোহণ করেও কি যথেষ্ট হয়নি? রাজ্যের মুখে আরও কালিমালেপন করা কি নিতান্তই জরুরি?

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৪০
চাকরির দাবিতে অনশন।

চাকরির দাবিতে অনশন।

শিক্ষামন্ত্রী একটি চমৎকার বাক্যবন্ধ ব্যবহার করেছেন— ‘যাঁরা ব্যতিক্রমী ভাবে চাকরি পেয়েছেন’। পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির পথে চাকরি পাওয়াকে ‘ব্যতিক্রমী’ বলা চলে, না কি সেটাই নিয়ম, শিক্ষামন্ত্রীকে আর এই কূটতর্কে টেনে লাভ নেই। আদালতের কাছে রাজ্য সরকার প্রস্তাব পেশ করেছে যে, এসএসসি-র মাধ্যমে যাঁরা ন্যায্যত চাকরি পাওয়ার যোগ্য, তাঁদের জন্য অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করে দেওয়া হবে, কিন্তু যাঁরা ‘ব্যতিক্রমী’ ভাবে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের চাকরিও থাকুক। এমন বৈপ্লবিক একটি অবস্থানের পিছনে দার্শনিক যুক্তিটি এই রকম— মুখ্যমন্ত্রী কারও চাকরি খেতে চান না। কোনও ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ-অপছন্দের দ্বারা রাজ্য সরকার নামক চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারিত হবে কেন, বঙ্গবাসী আর এই প্রশ্ন করবেন বলে মনে হয় না। পান্নালাল ভট্টাচার্য কবেই গেয়ে গিয়েছেন, ‘সকলই তোমার ইচ্ছা’। তবে এই আকালেও কেউ কেউ অবাক হতে পারেন, এমন প্রকট ভাবে অনৈতিক, অন্যায় একটি আবদার আদালতের কাছে পেশ করতে কারও, বিবেকে না হোক, চক্ষুলজ্জায় বাধল না? দুর্নীতির যে পাহাড় রাজ্যে গড়ে উঠেছে, তার শীর্ষে আরোহণ করেও কি যথেষ্ট হয়নি? রাজ্যের মুখে আরও কালিমালেপন করা কি নিতান্তই জরুরি?

রাজ্য সরকারের অবস্থানটি এক প্রবল ‘মরাল হ্যাজ়ার্ড’ বা নৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। বিপথে বা কুপথে পাওয়া চাকরিও যদি বজায় থাকে, যদি শাস্তি না হয়, তবে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্বাভাবিক যে, প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই, যোগ্যতার প্রশ্নটিও অবান্তর— টাকার জোরে বা অন্য কৌশলে এক বার চাকরি কিনে নিতে পারলে আর চিন্তা নেই। ঠিক যেমন, পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণের প্ল্যান পাশ করিয়ে আরও দু’তিনতলা তুলে তার পর ‘জরিমানা’ দিয়ে সব ঠিক করে নেওয়ার ব্যবস্থা গোটা রাজ্যেই চালু রয়েছে। সৎ প্রতিযোগিতা ও যোগ্যতা নির্ধারণের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই যে এতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, রাজ্য সরকার এই কথাটি ভাববে না? যাঁরা অসৎ পথে, ঘুষ দিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের বহিষ্কার করা এই দুর্নীতির তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার একটি মূল উদ্দেশ্য। এবং, সেটিই নৈতিক কাজ। রাজ্য সরকার কি বুঝিয়ে দিচ্ছে না যে, তাদের আচরণ ক্রমান্বয়ে এই প্রাথমিক নৈতিকতার বিরোধিতা করে চলবে? প্রশ্ন তো শুধু এই কয়েক জনের চাকরির নয়, প্রশ্ন গোটা ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাসের। কোন শিক্ষক ‘ব্যতিক্রমী’ ভাবে চাকরি পেয়েছেন, তা যে-হেতু শিক্ষকের কপালে লেখা থাকবে না, ফলে প্রত্যেক শিক্ষককেই ছাত্ররা ও বৃহত্তর সমাজ সন্দেহের চোখে দেখবে। সব শিক্ষককে এই অসম্মানের দিকে ঠেলে দেওয়ার অধিকার রাজ্য সরকারের আছে কি? অযোগ্য শিক্ষকের হাতে ছাত্রদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হবে, তার মূল্যও কি সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক লাভের তুলনায় কম?

মুখ্যমন্ত্রী কারও চাকরি খেতে চান না, এই কথাটির মধ্যে একটি নীতিবোধের সুর রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যদি বলতেন যে, এই রাজ্যে কেউ কর্মহীন থাকবেন, এটা তিনি মানবেন না— তা হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু, তিনি যা বলছেন, সেটা এই রকম: কেউ (যে কোনও প্রকারে) চাকরি জোগাড় করতে পারলেই রাজ্য সরকার সেই চাকরির নিরাপত্তা দেবে। যোগ্যতাও নয়, সমতাও নয়, মুখ্যমন্ত্রীর এই অবস্থান কার্যত যাকে সমর্থন করছে, তা হল দুর্নীতি করার সাধ্য, টাকা অথবা রাজনৈতিক সংযোগের জোর। যার সেই জোর আছে, রাজ্য সরকার তার স্বার্থরক্ষা করতে সর্বতো ভাবে সচেষ্ট হবে— এই কথাটি শিক্ষামন্ত্রীর উচ্চারণে অতি প্রকট। এতখানি অনৈতিক একটি অবস্থানের কথা লজ্জাহীন ভাবে উচ্চারণ করতে পারবেন রাজ্যের কর্ণধারেরা, অনতিঅতীতেও তা অবিশ্বাস্য ছিল। নীতিহীন রাজনীতির নিরন্তর সাধনা পশ্চিমবঙ্গকে সেই ‘ডিসটোপিয়া’য় পৌঁছে দিয়েছে।

SSC recruitment scam Bratya Basu Protest Mamata Banerjee West Bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy