পশ্চিমবঙ্গের বাজেট নথি খুললেই চোখে পড়বে তুলনামূলক পরিসংখ্যান— ২০১০-১১ অর্থবর্ষের তুলনায় রাজ্য আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই হিসাব। রাজ্যবাসীমাত্রেই জানবেন যে, এই তুলনার কোনও অর্থনৈতিক তাৎপর্য নেই; রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। অনুমান করা চলে, রাজ্যের মসনদে টানা তিনটি মেয়াদ কাটানোর পরও পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের কাছে একটি কথাই গুরুত্বপূর্ণ: বাম আমলের তুলনায় রাজ্যের উন্নতি ঘটেছে। নেহাতই ক্ষুদ্র রাজনীতির বার্তা প্রেরণ, না কি এর কোনও গভীরতর ব্যাখ্যা সম্ভব? সম্ভাব্য বিকল্প ব্যাখ্যাটি হল, পশ্চিমবঙ্গ যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাতে অন্য কোনও রাজ্যের সঙ্গে তার তুলনা করলে মাথা নিচু করা ছাড়া উপায় থাকবে না। রাজ্যের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য বিষয়ে যে সূচকটির কথা বারে বারেই ওঠে, জিএসডিপি-র অনুপাতে রাজ্যের ঋণ পরিমাণের কথাই ধরা যাক। কিছু পার্বত্য রাজ্য বাদ দিলে ভারতে এই অনুপাতটি বিপজ্জনকতম যে তিনটি রাজ্যে, পশ্চিমবঙ্গ তার অন্যতম। রাজ্যে এই অনুপাত প্রায় ৩৯%। বাকি দু’টি রাজ্য পঞ্জাব (জিএসডিপি-র অনুপাতে রাজ্যের ঋণ ৪৬.৬%) পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও খারাপ অবস্থায় রয়েছে, রাজস্থান তুলনায় ভাল (৩৫.৮%)। লক্ষণীয় যে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও পঞ্জাব এবং পশ্চিমবঙ্গ দেশের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির সারণিভুক্ত। স্পষ্টতই, অর্থব্যবস্থার পরিচালনায় সমস্যা রয়েছে। রাজ্য সরকারের ঋণ তখনই চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে, যখন আয় যথেষ্ট বাড়ে না। পশ্চিমবঙ্গ সেই সমস্যায় নিমজ্জিত। রাজ্য সরকার বাম আমলের ঋণের উত্তরাধিকারের কথা বলে থাকে— কিন্তু পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকার পরও সমস্যার সমাধান করে উঠতে না পারলে সে দোষ অন্যের কাঁধে চালান করা মুশকিল।
এ কথা ঠিক যে, ২০১৫ সাল থেকে ভারতের রাজ্যগুলির সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। চতুর্দশ অর্থ কমিশন কেন্দ্রীয় কররাজস্ব তহবিল থেকে রাজ্যগুলির প্রাপ্য ভাগের মাত্রা ৩২% থেকে বাড়িয়ে ৪২% করে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে রাজ্যগুলির উপরে উন্নয়নখাতে ব্যয়ের দায়িত্বও বহুলাংশে বাড়ে। স্পষ্টতই, বেশির ভাগ রাজ্যই সেই বোঝা সামলাতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গও নয়। কিন্তু, ঋণের অর্থ কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে, সেটাই ঠিক করে দেবে যে, এই ঋণ রাজ্যকে কোন পথে নিয়ে যাবে। একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। রাজ্যের ২০২৫-২৬ অর্থবর্ষের বাজেটে দেখা যাচ্ছে, বাজেটের মোট অর্থবরাদ্দের কত শতাংশ বাহ্যিক পরিকাঠামো নির্মাণের খাতে ব্যয় হচ্ছে— সেই অনুপাতটি কোভিড-অতিমারির সময়ে যে নিম্নগামী হয়েছিল, পাঁচ বছর পরেও তা পুরনো জায়গায় ফিরতে পারেনি। ঋণের অর্থ ব্যয় হচ্ছে এমন সব খাতে, যা সম্পদ গঠন করে না। বিশেষত, পুরনো ঋণের সুদ চোকানোর ক্ষেত্রে। সেই কারণেই, এই ঋণ ক্রমে তৈরি করেছে একটি অর্থনৈতিক বিষচক্র, যা থেকে নিস্তার পাওয়ার রাস্তা রাজ্য সরকারের জানা আছে কি না, সে সংশয় উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই।
ঋণ ও জিএসডিপি-র অনুপাতটি নির্ভর করে দু’টি অঙ্কের উপরে— ঋণ, এবং জিএসডিপি। স্কুলস্তরের পাটিগণিতের জ্ঞান বলবে, ঋণের পরিমাণ কমলে যেমন এই অনুপাত কমে, তেমনই জিএসডিপি-র পরিমাণ বাড়লেও অনুপাতটি কমে। আদর্শ পরিস্থিতিতে দু’টি কাজই এক সঙ্গে করা প্রয়োজন— বস্তুত, রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যথেষ্ট বাড়লে ঋণ করার প্রয়োজনও কমতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা হল, গত পনেরো বছরে সরকার মন দিয়েছে প্রত্যক্ষ সুবিধা হস্তান্তরের দিকে— এবং, দুর্নীতি সর্বব্যাপী হওয়ায় সেই প্রক্রিয়াটিও যথেষ্ট কুশলী হয়নি। আয় বৃদ্ধির কাজটি রাজ্যের শাসকদের কাছে অগ্রাধিকার পায়নি। সেই ভুল সংশোধনের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ঋণের এই বোঝাকে যদি সামলাতে হয়, তা হলে এখনই রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)