বিশ্ব প্রতিষেধক দান সপ্তাহ ছিল এই বছর এপ্রিলের ২৪ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত। প্রতি বছরই এপ্রিলের শেষ সপ্তাহটিতে এই কর্মসূচি পালিত হয় মূলত টিকাকরণের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব— এমন রোগগুলির ক্ষেত্রে টিকার ব্যবহারে উৎসাহ সঞ্চারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। প্রসঙ্গত, জনস্বাস্থ্যে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে তুলতে সফল টিকাকরণ কর্মসূচি অন্যতম হাতিয়ার। ভারতে ইতিপূর্বে পরিকল্পিত এবং নিবিড় টিকাকরণের মাধ্যমে পোলিয়োর মতো রোগকে নির্মূল করা গিয়েছে। সুতরাং, এই সাফল্যই যাতে অন্য সংক্রামক, প্রাণঘাতী, অথচ টিকাকরণের মাধ্যমে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, এমন অসুখগুলির ক্ষেত্রেও বজায় থাকে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। এই সূত্রেই এই বছর বিশ্ব প্রতিষেধক দান সপ্তাহ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নড্ডা দেশব্যাপী হাম-রুবেলা নির্মূলকরণ কর্মসূচির সূচনা করেছেন। ২০২৬ সালের মধ্যে ভারত হাম-রুবেলাকে দেশ থেকে নির্মূল করার লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির উদ্বোধনে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী শোনালেন, ১০০ শতাংশ মানুষকে প্রতিষেধক দানের আওতায় নিয়ে আসার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। জানালেন, হাম ও রুবেলা ভ্যাকসিনের দু’টি ডোজ় দেওয়ার মাধ্যমে শিশুদের উন্নততর জীবন যাপনের সুযোগ করে দেবে এই কর্মসূচি।
হাম-রুবেলা নিয়ে এ-হেন উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত শিশু এবং কিশোরদের ক্ষেত্রে রোগগুলি যথেষ্টই বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা করানো না গেলে হামের মতো রোগ প্রাণঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কর্মসূচির উদ্বোধনের জাঁকজমক এবং আশার বাণীও হাম-রুবেলা নিয়ে সরকারি লক্ষ্যপূরণের ব্যর্থতার অন্ধকারকে চাপা দিতে পারেনি। এই রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল করার জন্য সর্বপ্রথম কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ২০১৫ সালকে পাখির চোখ স্থির করেছিল। সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। অতঃপর তা পিছিয়ে দেওয়া হয় ২০২০ সালে। কিন্তু অতিমারির আক্রমণে অন্য টিকাকরণ কর্মসূচিগুলি যেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, হাম-রুবেলার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সুতরাং, নতুন করে ২০২৩ সালকে নির্দিষ্ট করা হয় রোগ নির্মূল করার সময়সীমা হিসাবে। সেই লক্ষ্যও অধরাই থেকে যায়। অতঃপর ২০২৬। ইতিমধ্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর তথ্য অনুযায়ী, টিকাকরণ কর্মসূচি সত্ত্বেও সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত ভারতে ৭,২০১ জন হাম-আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সুতরাং, উদ্বেগের কারণ রয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালে সমগ্র বিশ্বে যে এক লক্ষেরও অধিক হাম-আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল, তাদের অধিকাংশেরই বয়স ছিল পাঁচ বছরের নীচে। জানা গিয়েছিল, এদের হয় টিকাকরণ হয়নি, অথবা অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে। কেন নির্দিষ্ট সময়ে টিকাকরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা প্রয়োজন, এই পরিসংখ্যান থেকে তার আন্দাজ পাওয়া যায়।
বিশ্ব উষ্ণায়নের কল্যাণে এখন প্রায় সারা বছর ভাইরাসঘটিত রোগের আনাগোনা লেগে থাকে। দূষিত, উষ্ণ আবহাওয়ায় সংক্রমণের হারও বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, সংক্রামক এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত রোগগুলির ক্ষেত্রে পৃথক ভাবে সুসংহত পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক। সাধারণত হাম-রুবেলার ক্ষেত্রে দু’ডোজ় টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও বিশ্ব জুড়ে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বুস্টার টিকা নিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছে। সেই টিকাকরণ যাতে প্রত্যেক শিশুর কাছে পৌঁছে যেতে পারে, তার জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে টিকাকরণ যথাযথ হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। স্কুলগুলিতে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে অভিভাবকদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। শত্রু যখন চেনা, তখন তাকে পরাজিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করাই কাণ্ডজ্ঞানের পরিচায়ক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)