প্রতীকী ছবি।
তৈলাক্ত বংশদণ্ডে কপিশাবকের ওঠানামার হিসাবটি কেবলমাত্র কিশোরপাঠ্য গণিতগ্রন্থে মুখ ঢাকিয়া আছে ভাবিলে ভ্রম হইবে। উহা রাজনীতিতেও অতি প্রাসঙ্গিক— আফগানিস্তানের তালিবান জমানায় প্রত্যাবর্তন, এবং ক্রমশ পুরাতন বর্বরোচিত আইনকানুন বলবৎ হওয়া তাহারই প্রমাণ। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তালিবান-নিযুক্ত আচার্য মেয়েদের পড়ার ও পড়াইবার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছেন। তাঁহার মত, ইসলামই প্রথম, অতএব ‘সত্যকার ইসলামি পরিবেশ’ প্রতিষ্ঠা না হইলে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ নাস্তি। পূর্বতন তালিবান জমানাতেও মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাইবার অনুমতি ছিল না, পুরুষসঙ্গী ব্যতীত বাহির হওয়াও ছিল নিষেধ— অন্যথায় কশাঘাত। বস্তুত, যে যে পন্থায় মানবাধিকার শব্দটিকেই অলীক করিয়া তোলে তালিবানি শাসন, তাহার প্রথমটিই উগ্র নারীবিদ্বেষ এবং মেয়েদের উপর অত্যাচার। মানবীবিদ্যায় উহাকে ‘জেন্ডার অ্যাপারথেড’ বা লিঙ্গবিদ্বেষ বলিয়া চিহ্নিত করা হয়। তাহারা যে মৌলবাদী ও পশ্চাৎমুখী ক্ষমতাতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা করে, উহাতে নারীদের বস্তুরূপে গণ্য করাই দস্তুর।
যদিও, এই রূপ পশ্চাদ্গামিতা কি কাঙ্ক্ষিত ছিল? বিগত এক বৎসর যাবৎ শান্তি প্রক্রিয়ায় তালিবানি নেতৃত্ব বারংবার কিঞ্চিৎ নরম হইবার ইঙ্গিত করিয়াছিল। ধন্য আশা কুহকিনী! বাস্তবে শরিয়তি শাসনের বিভীষিকাময় দিনগুলিই ফিরিয়া আসিতেছে। তাহাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, এই বার পড়াশোনা ও চাকুরি করিবার অনুমতি পাইবে মেয়েরা, এমনকি সরকারেও তাহাদের অংশগ্রহণ থাকিবে। নারীবর্জিত নূতন প্রশাসন সেই সকলই মিথ্যা প্রমাণ করিয়াছে। স্মরণে রাখা জরুরি— তালিবান এক বিধ্বংসী সন্ত্রাসবাদী শক্তিও বটে। শাসন কায়েম রাখিতে তাহারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করিয়া জনসমাজকে পিষিয়া দিতে পারে, ক্ষমতাপীঠে আরোহণের জন্য অস্ত্র ও অর্থের প্রলোভনে সমগ্র সমাজকে বিষাইয়া দিতে পারে। সেই সকল কাহিনিও এখন আর অজ্ঞাত নহে। সুতরাং, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কাজটি হাসিল হইয়া গেলে যে তাহাদের সারহীন আশ্বাসবাণীসমূহও কর্পূরের ন্যায় বায়ুমণ্ডলে মিলাইয়া যাইবে, ইহাই স্বাভাবিক।
অতীতচারী হইলে যেমন অতল গহ্বরে তলাইয়া যাওয়াই ভবিতব্য বলিয়া মনে হয়, ভবিষ্যৎ অভিমুখে দৃষ্টি রাখিলে কিন্তু এতাদৃশ আশাহীনতার ভিতরেও আলোর ইঙ্গিতটুকু খুঁজিয়া লওয়া যায়। মেয়েদের বিরুদ্ধে ফরমান দিয়াছেন আচার্য, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মহিলা অধ্যাপক সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমে ক্ষোভ উগরাইয়া দিয়াছেন। যে সর্বাধিপত্যকামী ধর্মতান্ত্রিক শাসনে মেয়েদের জন্য পর্দার আড়ালটিই নির্দিষ্ট, অর্থাৎ বোরখা পরিধান না করিয়া রাস্তায় বাহির হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেইখানে প্রতি দিনই প্ল্যাকার্ড হাতে ছোট-বড় দলে ভাগ হইয়া রাজপথে নামিয়া পড়িতেছেন প্রতিবাদমুখর নারীরা— ইহা শুধু আনন্দের নহে, আশারও। শূন্যে গুলি ছুড়িয়া শাসকের ভীতিপ্রদর্শনের সম্মুখেও যাঁহারা অধিকারের দাবিতে অনড় থাকিতে পারেন, তাঁহারা নিঃসন্দেহে সমাজের ভরসা। আফগান সমাজ নিশ্চিত ভাবেই অবনমনের পথে; কিন্তু তাহা কত দূর হইবে আর কতখানি তাহা ঠেকানো যাইবে, এই হিসাবটি চালাইবার ক্ষমতা জনতা এখনও হারাইয়া ফেলে নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy