E-Paper

সংখ্যার পরে

উদ্বেগজনক মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যাও— ২০২২ সালের ছ’লক্ষ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ মেয়ের মধ্যে অন্তত দু’লক্ষ বসেনি উচ্চ মাধ্যমিকে (২০২৪)। অথচ, অন্তত ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখাই কন্যাশ্রীর উদ্দেশ্য।

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:০৪

আগামী বছর কন্যাশ্রীর প্রাপক-সংখ্যা এক কোটিতে পৌঁছনোর লক্ষ্য নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপাতদৃষ্টিতে এতে আপত্তির কিছু নেই। মেয়েদের মধ্যে স্কুলশিক্ষা, উচ্চশিক্ষার প্রসার রাজ্যের উন্নয়নের এক আবশ্যক শর্ত। ছাত্রীদের অনুদান বিতরণের এই প্রকল্প যে কিছু সাফল্য পেয়েছে, তার ইঙ্গিতও মিলেছে নানা ভাবে। যেমন, গত কয়েক বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যাই থাকছে বেশি। ২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলিতে (প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি) ছাত্রীদের সংখ্যা ছাত্রদের চেয়ে প্রায় দু’লক্ষেরও বেশি ছিল, যদিও একই সময়কালে সারা ভারতে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ছাত্রদের তুলনায় কম। মেয়েদের শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগে সমাজই লাভবান হবে। কিন্তু, মেয়েদের শিক্ষাকে কি কেবল অনুদান-প্রাপকের সংখ্যা দিয়ে মাপতে চায় সরকার? স্কুলে নাম লেখানোকেই ‘শিক্ষা’ বলে ধরে নেওয়া চলে না, স্কুলে উপস্থিতির হারও একটা মস্ত প্রশ্ন। পিএম-পোষণ প্রকল্পের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে চলতি শিক্ষাবর্ষে মিড-ডে মিল গ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা কমেছে প্রায় দশ লক্ষ। অন্তত পনেরোটি জেলায় নথিভুক্ত পড়ুয়াদের ৪০% স্কুলে খাচ্ছে না। কেন্দ্রের অপর একটি তথ্য বলছে, পড়ুয়াহীন স্কুলের সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে— রাজ্যের তিন হাজারেরও বেশি স্কুলে কোনও ছাত্রছাত্রী নেই। উদ্বেগজনক মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যাও— ২০২২ সালের ছ’লক্ষ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ মেয়ের মধ্যে অন্তত দু’লক্ষ বসেনি উচ্চ মাধ্যমিকে (২০২৪)। অথচ, অন্তত ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখাই কন্যাশ্রীর উদ্দেশ্য।

অপর উদ্দেশ্যটি হল বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ। ১৯৯৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভারতে সার্বিক ভাবে বাল্যবিবাহের হার দ্রুত কমলেও, পশ্চিমবঙ্গের ছবি নিরাশাজনক। একই সময়কালে এ রাজ্যে বালিকা বধূর সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছে পাঁচ লক্ষেরও বেশি। কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্পে বরাদ্দ না করেও বাল্যবিবাহ রোধে এগিয়ে রয়েছে ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান। পঞ্চম জাতীয় পরিবার সমীক্ষায় (২০১৯-২১) দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে আঠারো বছর বয়সে ৪১% মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ। ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০, এই পাঁচ বছরে বাল্যবিবাহ বেড়েছে দশটি জেলায়, যার কয়েকটিতে নাবালিকার বিয়ের হার ৫০% ছাড়িয়ে গিয়েছে। সাতটি জেলায় ১৫-১৯ বছরের মেয়েদের গর্ভধারণের হারও বেড়েছে। অথচ ২০২০ সালের মধ্যে কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য রাজ্য ব্যয় করেছে আট হাজার কোটি টাকারও বেশি। নাবালিকা বধূ, নাবালিকা প্রসূতিরা সকলেই কন্যাশ্রীর আওতার বাইরে ছিল, এমন ধরে নেওয়া চলে না। সরকারি স্কুলের খাতা এক ছবি দেখাতে চায়, বাস্তবে দেখা যায় অন্য চিত্র। নবজাতককে কোলে নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে নাবালিকা মা, সে ছবি বেরোয় সংবাদপত্রে। বহু ক্ষেত্রে অভিভাবক, স্থানীয় নেতাদের চাপে স্কুল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হচ্ছে বিবাহিত নাবালিকাদেরও ‘অবিবাহিত’ শংসাপত্র দিতে, যাতে তারা কন্যাশ্রীর অনুদান পায়।

অতএব, কেবল প্রকল্পের তালিকায় আরও নাম যোগ করলেই হবে না। কোনও প্রকল্পই সার্বিক শিক্ষা-পরিকল্পনার স্থান নিতে পারে না। কন্যাশ্রীর সাফল্যের প্রচারের পিছনে চাপা পড়ে যাচ্ছে ছাত্রদের স্কুলছুটের হার। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রদের স্কুলছুটের হার ২১%, যেখানে ছাত্রীদের ১৪%। কেন পাঁচ জনে এক জন কিশোর স্কুল ছাড়ছে? মানবসম্পদের এই অপচয় রোধ করার জন্য কী পরিকল্পনা নিচ্ছে রাজ্য সরকার? কী করছে রাজ্যের স্কুলপড়ুয়াদের দক্ষতা, সক্ষমতা বাড়াতে, স্কুলশিক্ষাকে অর্থপূর্ণ, আকর্ষণীয় করে তুলতে? এক কোটি একটা সংখ্যা। আর একটি সংখ্যা এক— এক জন শিশুও যেন স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই স্কুলছুট না হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Government Schemes Mamata Banerjee Girl students Child Marriage

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy