জনগণনার কাজ কবে শুরু হবে, সে খবর এখনও পাওয়া না-গেলেও কেন্দ্রীয় সরকার জানাল যে, এ বারের জনগণনায় জাতিগণনাও হবে। কংগ্রেস বা সমাজবাদী পার্টির মতো দলগুলি স্বভাবতই উচ্ছ্বসিত, কৃতিত্বের দাবিদার। সত্যিই যদি সরকার বিরোধী দলের চাপের সামনে নতিস্বীকার করে, গণতন্ত্রের পক্ষে তা সুসংবাদ। কিন্তু, আগাগোড়া জাতিগণনার বিরোধিতা করে আসা নরেন্দ্র মোদী সরকার শেষ অবধি যে তাতে সম্মতি দিল, সে কৃতিত্ব সম্ভবত প্রাপ্য বিহারের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের। কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহার জবাবে ২০২২ সালে বিহারে নীতীশ কুমারের সরকার জাতিগণনা করে। মোট ২১৪টি জাতির মধ্যে ২২টি তফসিলি জাতি, ৩২টি তফসিলি জনজাতি, ৩০টি ওবিসি এবং ১১৩টি জাতিকে এক্সট্রিমলি ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট বা অতি পশ্চাৎপদ জাতি হিসাবে গণ্য করা হয়। উচ্চ জাতি হিসাবে গণ্য হয় সাতটি জাতি। এই জনবণ্টনের রাজ্যে বিজেপির জাতিগণনায় অনীহা তাদের পশ্চাৎপদ জাতি-বিরোধী হিসাবে প্রতিপন্ন করবে, এই আশঙ্কা প্রবল। তারই কাটান হিসাবে জাতিগণনার সিদ্ধান্ত, এমনটা ধরে নিলে সম্ভবত ভুল হবে না। এক অর্থে, বিজেপি একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করল। ভি পি সিংহের আমলে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার প্রতিক্রিয়ায় বর্ণহিন্দু স্বার্থরক্ষায় আডবাণীর রথযাত্রা যদি সেই বৃত্তের সূচনাপর্ব হয়, তবে তার পরবর্তী সাড়ে তিন দশকে ক্রমে বিবিধ নিম্নবর্গীয় দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ পেরিয়ে শেষ অবধি জাতিগণনায় সম্মত হওয়ার মাধ্যমে যাত্রার সমাপ্তি ঘটল। বৃত্তটি বিজেপির রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন ক্ষমতার পরিচায়ক।
জাতিগণনায় বিজেপির আপত্তির কারণটি স্পষ্ট— দলের বৃহৎ হিন্দুত্বের বয়ানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব অনপনেয়। কিন্তু, সেই দ্বন্দ্বের চরিত্রটিও ধ্রুব নয়। ১৯৯০-এর দশকে জনমানসে— বিশেষত, তথাকথিত নিম্নবর্ণের বিচারে— বিজেপি যতখানি উচ্চবর্ণের দল ছিল, ২০২৫-এ দলের চরিত্র যদি না-ও বা পাল্টিয়ে থাকে, জনমানসে তার ভাবমূর্তিটি পাল্টেছে। বিশেষত গত দশ বছরে অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। উল্লেখ্য যে, এই সময়কালেই আর্থিক অনগ্রসরতার ভিত্তিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে বিজেপি— অর্থাৎ, ঐতিহাসিক বঞ্চনার যুক্তিটির গুরুত্ব হ্রাস করার চেষ্টা অব্যাহত। কিন্তু, তার পরও, অনুমান করা চলে, বর্তমানে বিজেপি রাজনৈতিক ভাবে এমন অবস্থানে আছে বলেই নেতাদের ধারণা যে, জাতিগণনায় সম্মত হয়ে বিরোধী পক্ষের পালের হাওয়া কাড়ায় তাঁরা লাভই দেখছেন। বললে ভুল হবে না যে, জাতিগণনার সিদ্ধান্তটি মূলত রাজনৈতিক— জনসংখ্যায় পশ্চাৎপদ অংশের অনুপাত বিচার করে তাঁদের জন্য উন্নয়ন নীতি পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি তুলনায় গৌণ।
কারণ যা-ই হোক না কেন, জাতিগণনার সিদ্ধান্তটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, অনেকগুলি প্রশ্ন আছে। প্রথমত, জনগণনার কাজ কবে থেকে শুরু হবে, তার কোনও সময়রেখা এখনও ঘোষিত হয়নি। ফলে, বর্তমান সিদ্ধান্তটি বিহারের নির্বাচন উপলক্ষে ঝুলিয়ে দেওয়া গাজরমাত্র কি না, সে সংশয় গভীর। দ্বিতীয় প্রশ্ন, কোন ভিত্তিতে গণনা হবে? তফসিলি জাতি এবং জনজাতিগুলি সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত— নির্দিষ্ট সময় অন্তর সে তালিকায় সংসদীয় প্রক্রিয়ায় সংশোধন হয়। কিন্তু, ওবিসি-র ক্ষেত্রে যেমন কেন্দ্রীয় তালিকা রয়েছে, তেমনই প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব তালিকা রয়েছে— এবং, কার্যত প্রতিটি রাজ্যের ক্ষেত্রেই সেই তালিকা কেন্দ্রীয় তালিকার চেয়ে দীর্ঘতর। জাতিগণনায় কোন তালিকা গ্রাহ্য হবে? উন্নয়ন নীতির ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন অতি তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১১ সালের জাতিগণনা এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গিয়েছিল— ওবিসি-দের গোনা হয়েছিল ‘অন্যান্য’ জাতির অধীনে। এ বারও কি সরকার সে পথেই হাঁটবে? তা ঘটলে প্রক্রিয়াটি গুরুত্ব হারাবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)