যে কোনও মৃত্যুই দুঃখের, কিন্তু কোনও কোনও মৃত্যুর ঘটনা স্তব্ধ করে দেয়। আমদাবাদে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান-দুর্ঘটনার অভিঘাত তেমনই। ১২ জুন দুপুর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রচারমাধ্যম জুড়ে যে সব খবর, তথ্য, ছবি, ভিডিয়ো পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলি এতই মর্মান্তিক ও হৃদয়-বিদারক যে দেখে-শুনে অবিচল থাকা অসম্ভব। রোদ-ঝলমল দুপুরে ২৪২ জন যাত্রী ও বিমানকর্মী নিয়ে সর্দার বল্লভভাই পটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড়ে যাওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকার মানুষ স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, দূর আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে বিরাট এক বিমান নেমে আসছে জনবসতির দিকে, তার পরেই বিকট বিস্ফোরণ, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। অঙ্কের হিসাবে বিমান-দুর্ঘটনার আশঙ্কা অতি নগণ্য, ভারতে গত পাঁচ বছরে ট্রেন-দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গিয়েছেন তার পাশে বিমান-দুর্ঘটনার সংখ্যা, হার বা তাতে প্রাণহানি, সবই খুব কম। কিন্তু তার পরেও যখন তা ঘটে তখন ক্ষতির মাত্রা সীমা ছাড়ায়: আমদাবাদে ২৪২ জনের মধ্যে শুধু এক জন বেঁচে গিয়েছেন অবিশ্বাস্য ভাবে, বাকি সবাই মৃত, এবং এমন ভাবে মৃত যে তাঁদের দেহ বা দেহাংশ শনাক্ত করতে হচ্ছে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে। লন্ডনপ্রবাসী যে ভারতীয় ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন, যে ডাক্তার-পরিবারটি ভিন দেশে নতুন জীবন শুরু করতে চলেছিল, বিদেশি যে যুগল বিমানে ওঠার আগেই বন্ধুদের পাঠিয়েছিলেন হাসিমুখের ছবি, কয়েক মুহূর্ত পরেই তাঁরা মৃত, অতীত হয়ে গেলেন। ততটাই দুঃখের ও আতঙ্কের, বিমানটি ভেঙে পড়ল স্থানীয় মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসের একটি বাড়িতে, ডাক্তার-পড়ুয়ারা তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন! মোট কত জন যে এই দুর্ঘটনার জেরে মৃত, সেই হিসাবটি কষা চলছে এখনও— এই কি বুঝিয়ে দেয় না ঘটনাটির বীভৎসতা?
এমন ভয়ঙ্কর ঘটনার গা ঘেঁষেই আসে তার কারণ-অনুসন্ধান পর্ব। নানা মত, তর্ক, ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ঘোরাফেরা করছে জনপরিসরে। আমদাবাদে দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটি ছিল বোয়িং-৭৮৭ ড্রিমলাইনার— এই মডেলের বিমান নিয়ে নানা পূর্বতথ্য সামনে এসেছে। এক প্রাক্তন প্রকৌশলী কর্মী এই মডেলের বিমান ও তার যন্ত্রপাতির গুণমান রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন আগেই, কিন্তু বিমান নির্মাতা সংস্থা তা অস্বীকার করে। উল্টো দিকে রয়েছে এই তথ্যও: বিশ্বে নানা দেশে নানা আকাশপথে বহু বিমান সংস্থা এই মডেলের বিমান ব্যবহার করছে, কিন্তু এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা এই প্রথম ঘটল, এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভারতে। অভিযোগ, অনুমান ও আশঙ্কা— এই সম্মিলিত ধোঁয়াশায় বিমান ভেঙে পড়ার মূল কারণ এখনও স্পষ্ট নয়; উদ্ধারকাজ শেষে, আধুনিক প্রযুক্তি সহায়ে ও উপযুক্ত তদন্তে হয়তো তা বেরিয়ে আসবে। এই অনুসন্ধান ও তদন্ত সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ ভাবে হবে, এই নিশ্চয়তাই এই মুহূর্তে দরকার। যাঁরা চলে গেলেন তাঁরা আর ফিরবেন না, কিন্তু তাঁদের শোকার্ত প্রিয়জনের জন্য তা-ই হবে ন্যূনতম সান্ত্বনা— এই মর্মান্তিক ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত একটি ‘দুর্ঘটনা’। বিমান উড়ে যাওয়ার আগে সব কিছু বারংবার ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখে নিয়ে তবে উড়ান-অনুমতি মেলে। তদন্তে যদি উঠে আসে যে এই বিমানটির ক্ষেত্রে তা হয়নি, তবে যে বা যাদের গাফিলতিতে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটল, তাদের উপযুক্ত শাস্তিবিধান নিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। ভারতে বিশেষত এই ধরনের বিশেষ ভাবে পেশাদার ও ‘হাই-প্রোফাইল’ তদন্তের ক্ষেত্রে মূল কারণ ধামাচাপা পড়ার পূর্বদৃষ্টান্ত কম নয়, তার পিছনে থাকে আর্থিক থেকে রাজনৈতিক নানা স্বার্থের সিদ্ধি। সেই অসুস্থ ঘূর্ণিপাকে, এবং বিরাট আর্থিক ক্ষতিপূরণ ঘোষণার আবহে যেন এই ভয়ঙ্কর ঘটনার তদন্তটিও ধামাচাপা না পড়ে, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বুঝতে হবে, এয়ার ইন্ডিয়া এই মুহূর্তে বেসরকারি সংস্থার মালিকানাধীন হলেও তার সঙ্গে ভারতীয় অসামরিক বিমান-চলাচলের ঐতিহ্যটি অঙ্গাঙ্গি। সেই ঐতিহ্য রক্ষাও একটা বড় দায়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)