সমাজমাধ্যমে করা কোনও মন্তব্য থেকে পুলিশি হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়তে হতে পারে, গ্রেফতার করাও হতে পারে— আজকের ভারতে এই আশঙ্কায় ভোগেন কত জন? ২০২৩ সালের স্টেটাস অব পোলিসিং ইন ইন্ডিয়া রিপোর্ট নামক একটি বেসরকারি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, অংশগ্রহণকারীদের দুই-তৃতীয়াংশেরই এই আশঙ্কা রয়েছে। এবং, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে এই আশঙ্কার তীব্রতা বেশি। কেন, সেই কারণটি সম্ভবত ব্যাখ্যা না করলেও চলে। কিন্তু প্রশ্ন হল, অনলাইন দুনিয়ায় নজরদারি এবং দমনমূলক আচরণ কি বিজেপির একচেটিয়া, না কি যে যায় ক্ষমতায়, সে-ই দমননীতির পক্ষপাতী হয়ে ওঠে? এই প্রশ্নটির উত্তরও একই রকম স্পষ্ট। তাকে স্পষ্টতর করছে কর্নাটকের প্রস্তাবিত মিসইনফর্মেশন অ্যান্ড ফেক নিউজ় (প্রহিবিশন) বিল, ২০২৫। সমাজমাধ্যমে ভুয়ো খবর ছড়ালে এই আইনের অধীনে সাত বছর অবধি কারাদণ্ড হতে পারে; ১০ লক্ষ টাকা অবধি জরিমানারও ব্যবস্থা রয়েছে।
ভারতে তথ্যপ্রযুক্তি আইন, বা বিভিন্ন রাজ্যের ভুয়ো খবর সংক্রান্ত যে আইন এখনও অবধি রয়েছে, কর্নাটকের প্রস্তাবিত আইনটি সেগুলির তুলনায় কঠোরতর। ঘোষিত উদ্দেশ্যটি মহৎ— অপতথ্য বা ভুয়ো খবর প্রচার করে কেউ যাতে সামাজিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত না করতে পারে, তার জন্যই রাজ্যের কংগ্রেস সরকার এই কঠোর আইনের ব্যবস্থা করছে। তবে সন্দেহ হয়, প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্ভবত বিরোধী-কণ্ঠস্বর দমনে অন্য সব রাজ্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া— ত্রাসের রাজত্বে বিজেপির একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙতে কর্নাটকের কংগ্রেস সরকার দৃশ্যত উদ্গ্রীব। মজার কথা হল, ২০২৪ সালের কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে বড় গলায় বলা হয়েছিল অবাধ বাক্স্বাধীনতা রক্ষা করার কথা; তাতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এমন যে কোনও আইন প্রত্যাহার করার কথা। অনুমান করা চলে, ইস্তাহারটি রচিত হয়েছিল কংগ্রেসের বিরোধী সত্তায়; আর কর্নাটকে দল রয়েছে শাসক সত্তায়।
প্রস্তাবিত আইনটিতে সমস্যা কোথায়, তা বুঝতে আইনজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই গোত্রের যে কোনও আইনই ব্যবহৃত হতে পারে বিরোধী-কণ্ঠ দমনে, নাগরিককে ত্রস্ত করে রাখার কাজে। কোন পথে, তা এক দশক আগে শ্রেয়া সিংহল বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়েছিল— কোনও আইনে অপরাধের সংজ্ঞা যত অস্বচ্ছ, নাগরিক অধিকার খণ্ডনে সেই আইন ব্যবহারের সম্ভাবনা ততই বেশি। কর্নাটকের প্রস্তাবিত বিলটি এমন আইনি সংজ্ঞার উদাহরণ। জ্ঞানত অথবা অসতর্কতাবশত করা যে কোনও অসত্য মন্তব্যই মিসইনফর্মেশন বা অপতথ্য হিসাবে বিবেচিত হতে পারে; ভুয়ো খবরের আওতায় আসবে ভুল উদ্ধৃতি থেকে বানানো ছবি, সবই। অর্থাৎ, কোনটি ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচার, আর কোনটি সৎ ভ্রান্তি, সেই বিবেচনার পরিসরটি অতি সঙ্কুচিত। এখানেই শেষ নয়— নারীবাদ বিরোধী, এবং সনাতন প্রতীকের প্রতি অসম্মানজনক বক্তব্যও এই আইনের আওতায় আসবে। এই বিষয়গুলি কী, সংবিধানে স্বভাবতই তার কোনও সংজ্ঞা নেই, অর্থাৎ বিবেচনাটি এই আইনের কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত হবে। শুধু পুলিশি অভিযোগের মাধ্যমেই নয়, এই আইন বলবৎ হতে পারে ‘ফেক নিউজ় অন সোশ্যাল মিডিয়া রেগুলেটরি অথরিটি’ নামক কর্তৃপক্ষের নির্দেশেও। সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার ছয় সদস্যের মধ্যে এক জন রাজ্যের তথ্যমন্ত্রী; তিন জন বিধায়ক, খুব সম্ভবত যাঁরা শাসক দলের সদস্য হবেন; এবং দু’জন শিল্প প্রতিনিধি। বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বহীন এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে থাকবে বাক্স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের গুরুদায়িত্ব। বিলটি পাশ হয়ে তা আইনে পরিণত হলে সেই আইনের চরিত্র কী হবে, বুঝতে সমস্যা নেই। কর্নাটকের কংগ্রেস সরকার প্রমাণ করতে মরিয়া যে, নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে তারাও কম যায় না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)