E-Paper

উৎসবের ‘সবাই’

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নানা উপন্যাসে গ্রামীণ যৌথ পরিবারের যে ছবি বার বার উঠে এসেছে, সেখানে পীড়ন-অপমানের বোঝাটা সহজ সৌহার্দকে বহুগুণ ছাড়িয়ে যেত প্রায়ই।

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৪৮

সবাই মিলে আনন্দ করাই হল উৎসব, কিন্তু এই ‘সবাই’-এর মধ্যে পড়ে কে কে? বাষট্টি বছর আগে সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর ‘হৃদয়চর্চা’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “কুটুম্ব নেই। শব্দটি পর্যন্ত ভাষা থেকে উঠে গেছে।” যেমন শোনা যায় না ‘জ্ঞাতি’ বা ‘জ্ঞাতিগোষ্ঠী’ শব্দগুলি। যদি বা বলা হয়, তবে তা নিকটজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না বুঝিয়ে খানিকটা পরিহাসের ছলে বলা হয়, লোকসংখ্যার বাহুল্য বোঝাতে। “গুষ্টির লোক জড়ো হয়েছে”— তার উদাহরণ। ‘পরিবার’-এর সংজ্ঞা খোলা-শাঁস বাদ দিতে দিতে এসে পৌঁছেছে আঁটিতে। মায়ের মামাতো দাদার শালার স্ত্রী ‘মামি’ হয় না ‘বৌদি’ হয়, সেই জটিল ধাঁধার উত্তর খোঁজার দায় থেকে মুক্ত এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। খুব প্যাঁচে পড়ে গেলে বলে দেয়, ‘কাজ়িন’। তবে কিনা, সেই চ্যালেঞ্জ এখন আর তৈরিই হয় না, কারণ উৎসব বৃহত্তর পরিবারের দিকে তেমন এগোয় না— তা দোল-দুর্গোৎসবই হোক আর শ্রাদ্ধ-অন্নপ্রাশনই হোক। সে জায়গা নিয়েছে আবাসন বা পাড়ার মানুষ, বন্ধুরা। এই সব সম্পর্কে অন্তরঙ্গতার পরিমাপ নিজের নির্মিত। নরেন্দ্রনাথ স্বভাবসিদ্ধ রসবোধে লিখেছিলেন, “হৃদয়ের থেকে হাতের দূরত্ব দেড় হাতের চেয়ে তো আর বেশি নয়। তাই বন্ধুত্বের সংজ্ঞা যত ব্যাপকতর হচ্ছে, তত গভীরতর হচ্ছে না। ...বৈঠকখানার চৌকাঠ পার করে হৃদয়ের অন্দরমহলে যাঁদের স্থান দিতে পারি, এবং যাঁদের হৃদয়ে স্থান পেতে পারি, তেমন সুজন স্বজনের সংখ্যা কজন?” এ সব সম্পর্ক এক ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের সহযাত্রিত্বের মতো, বলছেন তিনি।

তা বলে একশো বছর আগের সেই যৌথ পরিবারে, একত্র বাসই কি আর সর্বদা হৃদয়ের সম্পর্ক হয়ে উঠত? শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নানা উপন্যাসে গ্রামীণ যৌথ পরিবারের যে ছবি বার বার উঠে এসেছে, সেখানে পীড়ন-অপমানের বোঝাটা সহজ সৌহার্দকে বহুগুণ ছাড়িয়ে যেত প্রায়ই। ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে বহু দিন পরে ঘরে প্রত্যাগত রমেশের চোখ দিয়ে গ্রামের সেই ছবি দেখিয়েছেন শরৎচন্দ্র, যেখানে লোকেরা আত্মীয়তা, প্রতিবেশিতার বন্ধনে নিবিড় ভাবে আবদ্ধ, আবার একই সঙ্গে রেষারেষিতে দীর্ণ। পিতৃশ্রাদ্ধে কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করতে হবে, রমেশের সে প্রশ্নের উত্তরে জ্যাঠাইমা বিশ্বেশ্বরী বলেন, “এ গাঁয়ে যে আবার,— আর এ গাঁয়েই কেন বলি, সব গাঁয়েই— এ ওর সঙ্গে খায় না, ও তার সঙ্গে কথা কয় না— একটা কাজকম্ম পড়ে গেলে আর মানুষের দুর্ভাবনার অন্ত থাকে না। কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখা যায়, এর চেয়ে শক্ত কাজ আর গ্রামের মধ্যে নেই।” বহিরঙ্গে যা উৎসব, অন্তরের দিক থেকে তা-ই হয়ে উঠতে পারে পীড়ন। উপন্যাস এগোতে আমরা দেখি, রমার আয়োজিত দুর্গোৎসবের অন্ন-ব্যঞ্জন শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে, হিন্দু ও মুসলিম প্রজারা জমিদারের পুজো বর্জন করেছে। গত বছর আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে ‘দ্রোহের কার্নিভাল’-এ গিয়েছিলেন বিপুল সংখ্যক মানুষ, সরকার-আয়োজিত প্রতিমা বিসর্জনের ‘কার্নিভাল’-কে বর্জন করে।

হৃদয়ের আনন্দের সঙ্গে উৎসবের উদ্‌যাপনকে নিবিড় ভাবে বাঁধতে চেয়েছিলেন বলে নানা নতুন উৎসবের সূচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জগৎ-চরাচর জুড়ে নিত্য-প্রবাহিত আনন্দধারা সে দিনই ‘উৎসব’ হয়ে দেখা দেয়, যে দিন মন তাতে যোগ দিতে উৎসুক হয়। সে দিন খুলে যায় দক্ষিণের দ্বার, সবার আসার পথ। শান্তিনিকেতনে পৌষের উৎসবের অভিভাষণে (১৯৩৪) তিনি বলছেন, “...আমাদের উৎসবটা কবে? যেদিন আমরা সময় করতে পারি সেই দিন। যেদিন হঠাৎ হুঁশ হয় যে আমাদের নিমন্ত্রণ আছে... যে দিন স্নান করে সাজ করে ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি।” এই নিমন্ত্রণ দায়ের নয়, দয়ার নয়, আর সমাজমাধ্যমে আত্মপ্রদর্শনীর অছিলাও নয়। নিজের ক্ষুদ্রতা, স্বভাব-কার্পণ্যকে ছুটি দিয়ে অন্যের নিমন্ত্রণ গ্রহণ, অপরকে নিমন্ত্রণের দিনটিই হল উৎসব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

festival Society Literature Programme Protest

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy