E-Paper

কলঙ্ক-নাট্য

১৯৪৮ সালকে শ্যামাপ্রসাদের মনে হয়েছিল বাঙালি সমাজের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সঙ্কটকাল। এ দিকে তাঁরই রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের কারণে বর্তমান সময় অর্থাৎ ২০২৫ সালে বাঙালি আরও অনেক বড় সঙ্কটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত।

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:১৯

আজ আমরা যে সঙ্কটের মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি, বাঙালি সমাজের ইতিহাসে এমন সঙ্কট ইতিপূর্বে আসে নাই।” ১৯৪৮ সালে, দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের সভাপতির অভিভাষণে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন। সদ্যবিভক্ত ভারতে দাঁড়িয়ে কোন সঙ্কটের কথা তিনি বলেছিলেন তা সহজেই অনুমেয়, যদিও সহজে বোধগম্য নয়। তিনি ও তাঁর দল হিন্দু মহাসভা দেশভাগ ও বাংলাভাগের পক্ষেই মত দিয়েছিলেন— সুতরাং দেশভাগ-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের সঙ্কটমুক্ত বোধ করারই কথা। সে যা-ই হোক, ওই বক্তৃতায় তিনি বারংবার বাংলার দুই মনীষীকে স্মরণ করে তাঁদের সাংস্কৃতিক মূলধনের উপর ভর করে বাঙালিকে আবার শক্ত হয়ে দাঁড়াতে বলেন। এই দুই মনীষী— বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শ্যামাপ্রসাদের মতে, সাহিত্য শুধু জীবনের ছবি প্রতিফলিত করেই ক্ষান্ত হয় না, সাহিত্য জাতিগঠনের পথ দেখায়। “ভাষা ও সাহিত্যের পথ দিয়াই বঙ্কিমচন্দ্র জাতিগঠনে অগ্রসর হইয়াছিলেন। …তাঁহার তিরোধানের পর রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সমাজের পথ প্রদর্শন করিয়াছেন। বাঙালি সাহিত্য-প্রতিভা এক দিন জাতিগঠনের প্রয়োজন সিদ্ধ করিয়াছে। আজ চরম দুর্দিনে সমাজকে রক্ষা করিবার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করিয়া তাহার প্রাণে পুনরায় বল সঞ্চার করুক, ইহাই প্রার্থনা।” বলেছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দে মাতরম্’ দেশমন্ত্র প্রচার করেছেন, আর রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব সঙ্গীত বাঙালি চিত্তে দেশপ্রীতির উৎস খুলে দিয়েছে: ‘ও আমার দেশের মাটি/ তোমার পরে ঠেকাই মাথা’।

১৯৪৮ সালকে শ্যামাপ্রসাদের মনে হয়েছিল বাঙালি সমাজের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সঙ্কটকাল। এ দিকে তাঁরই রাজনৈতিক উত্তরাধিকারীদের কারণে বর্তমান সময় অর্থাৎ ২০২৫ সালে বাঙালি আরও অনেক বড় সঙ্কটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত। কারণ, যে বঙ্কিম ও রবীন্দ্র ঐতিহ্যকে শ্যামাপ্রসাদ ভেবেছিলেন চরম দুর্দিনে বাঙালি সমাজকে রক্ষা করার সহায় ও সম্বল, এখন সেই দুই জনকে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পরস্পরের বিরুদ্ধে। প্রচারমাধ্যমে রাত্রিদিন ধ্বনিত হচ্ছে ‘বঙ্কিমচন্দ্র বনাম রবীন্দ্রনাথ’ নামক তরজা, তাতে গলা মেলাচ্ছেন কিংবা কলম চালাচ্ছেন একের পর এক রাজনৈতিক ব্যক্তি, এমনকি সাহিত্য-সংস্কৃতির জোগানদার। এই দুই সাহিত্যতারকা অকস্মাৎ পরস্পরের বিরুদ্ধ হয়ে উঠবেন, কিছু কাল আগেও ভাবা দুষ্কর ছিল। অথচ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রকোপে পশ্চিমবঙ্গবাসী দ্রুত এই তথাকথিত দ্বৈরথে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। বঙ্কিম-ঐতিহ্যটিকে সনাতনী বলে দেখা, আর রবীন্দ্র-ধারাটিকে প্রগতিবাদী বা উদারবাদী, সুতরাং পরিত্যাজ্য বলে প্রচার করা— এই হল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিদ্বেষ প্রচার। তার সঙ্গে মিশেছে বাঙালি সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করে তাকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা, প্রধানত বাংলার বাইরের হিন্দুত্ব-নেতৃত্বের উদ্যমে। মনে রাখা ভাল, যে সঙ্কীর্ণ সামাজিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে রবীন্দ্রনাথকে খলনায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, বাঙালির কাছে তা কেবল অসম্মানের বিষয় নয়, ভয়ানক বিপজ্জনক।

সঙ্কীর্ণতাবাদীদের কাছে রবীন্দ্রনাথের ‘দোষ’, তিনি সকলকে নিয়ে ‘ভারততীর্থ’ তৈরির কথা বলেছিলেন। ধর্মের দোহাই পেড়ে ভারতবাসীর মধ্যে ভেদাভেদ করার বিরোধী ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে তাঁর মতি বা গতি ছিল না। মানবিক কল্যাণে মনঃসংযোগই ছিল তাঁর ধর্মাচরণের পথ। ঠিক এই কারণেই আজকের ভারত ও আজকের বাংলাদেশ, দুই দেশেই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাবাদীরা তাঁর প্রতি চরম বিদ্বিষ্ট। দুই দেশেই তাঁর প্রতি তীব্র আক্রমণ ধাবিত। লক্ষণীয়, একই সময়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাংলাদেশের ইসলামি মৌলবাদীদেরও চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে, এ গানের জাতীয় সঙ্গীত পরিচয় ঘোচাতে চায় তারা। অন্য দিকে, ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের মতে, এই গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বলেই ভারতে পরিত্যাজ্য। কেবল মৌলবাদী জনতা নয়, অসম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও মত দিয়েছেন, এ গান গাওয়া ‘দেশদ্রোহিতা’। প্রশ্ন হল, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ, বন্দে মাতরম্ ও জনগণমন— এই দুইকে যাঁরা মিলিয়ে চলতে না পারেন, তাঁরা ভারতীয় রাজনীতি করেন কী করে। এখানেই আসে সেই সর্ববৃহৎ বিপদের কথাটি। অসহিষ্ণু মৌলবাদীরা এখন প্রকাশ্যেই বাঙালিকে ‘রবীন্দ্রনাথ ধুয়ে খেতে’ বারণ করে, কেননা তিনি তাদের দেশবীক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীতে বিরাজমান। রবীন্দ্রনাথ একা নন। বাঙালি নবজাগরণের মুখগুলি নিয়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অনেক দিনের সমস্যা। ছয় বছর আগে বাংলার মাটিতে বিদ্যাসাগরকে কলঙ্কলিপ্ত করা হয়েছিল। এ বারের লক্ষ্য রবীন্দ্রনাথ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Hinduism Fundamentalism Rabindranath Tagore Bankim Chandra Chattopadhyay Shyamaprasad Mukherjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy