শীর্ষ আদালত আধার-কে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য দ্বাদশতম নথি হিসাবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়ার পর নির্বাচন কমিশন তা মান্য করবে, এবং সংযত আচরণ করবে, এমন আশা ছিল। কমিশন তাকে ভিত্তিহীন প্রতিপন্ন করেছে। ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন সংক্রান্ত একটি মামলায় কমিশন আদালতকে জানিয়েছে, সংবিধান অনুসারে ভোটার তালিকা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার একমাত্র তাদেরই। সে বিষয়ে আদালত কোনও নির্দেশ দিলে তাতে নাকি শাসন বিভাগের সংবিধাননির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করা হবে। কমিশনের অবস্থানটির আইনি যাথার্থ্য অন্যত্র বিবেচ্য। কিন্তু ঘটনা হল, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এর আগে কোনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দেশের শীর্ষ আদালতের সঙ্গে তাদের সংঘাতকে এমন চড়া তারে বাঁধেনি। আদালতের স্পষ্ট বার্তা সত্ত্বেও বিহারে ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনের ক্ষেত্রে আধারকে বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য নথি হিসাবে স্বীকার করতে নির্বাচন কমিশন যে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে, তা কার্যত নজিরবিহীন। বস্তুত, আদালত আধারকে দ্বাদশ নথি হিসাবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়ার পরও কমিশনের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, এই নির্দেশের কথা প্রচার করার আদৌ কোনও প্রয়োজন কমিশনের নেই। আর এখন কমিশন সরাসরি সাংবিধানিক এক্তিয়ারের লড়াইয়ে নেমেছে। গত দু’মাসের ঘটনাক্রম থেকে কারও মনে হতেই পারে যে, নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনের বিষয়টিতে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ এড়াতে মরিয়া, তা যে কোনও ভাবেই হোক।
অতএব, প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, নির্বাচন কমিশনের এমন মরিয়া অবস্থা কেন? বিহারে ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়াটি যে ভঙ্গিতে শুরু হয়েছিল, তাতে এই আশঙ্কা প্রকট ছিল যে, এক বিপুল সংখ্যক মানুষ এতে ভোটদানের অধিকার হারাবেন। এতে সরাসরি তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিল হবে না ঠিকই, কিন্তু নির্বাচনী গণতন্ত্রে ভোটদানের অধিকার হারানোর অর্থ, দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হওয়া। এক প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে, নাগরিকত্ব প্রমাণের দায়টি নাগরিকের উপরে চাপিয়ে দিয়ে কমিশন জনগণের আস্থার অপূরণীয় ক্ষতি করছে। রাহুল গান্ধী সাংবাদিক সম্মেলনে যে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতপূর্ণ এবং বেআইনি আচরণের যে অভিযোগগুলি করেছেন, তেমন অভিযোগ ওঠাও যথেষ্ট দুর্ভাগ্যের। আগামী ৭ অক্টোবর আদালতে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন বিষয়ক মামলার শেষ শুনানি— শীর্ষ আদালত জানিয়েছে যে, প্রক্রিয়াটি যদি অসাংবিধানিক প্রতিপন্ন হয়, তবে গোটা দেশের ক্ষেত্রেই নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া বাতিল হতে পারে। প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশন কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এমন জায়গায় পৌঁছল? এমনই চরম অবস্থান যে, কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন উঠছে? কমিশনও কি তবে পরিণত হয়েছে ‘খাঁচাবন্দি তোতা’-তে?
নির্বাচন কমিশনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বিষয়ে এমন প্রশ্ন উঠছে, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে অতি লজ্জার। কিন্তু, প্রশ্নটি এখন এমনই অনিবার্য হয়ে উঠেছে যে, তার উত্তর দেওয়ার দায়টি অস্বীকার করা চলে না। উত্তর দিতে হবে দেশের শাসকদেরই। ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার কারণ হিসাবে ‘অনুপ্রবেশ’-এর প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে। এ দিকে, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনমুখী রাজ্যগুলিতে একের পর এক জনসভায় বলে চলেছেন, অনুপ্রবেশের কারণে দেশের বিভিন্ন অংশে জনবিন্যাস পাল্টে গিয়েছে, এবং সরকার এই ‘ষড়যন্ত্র’-এর বিরুদ্ধে জনবিন্যাস মিশন তৈরি করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রধানমন্ত্রীর এই দাবির সমস্যাগুলি স্পষ্ট (‘আগুন নিয়ে খেলা’, সম্পাদকীয়, ১৭-৯)। কমিশনের অবস্থানটিও শাসকদের এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অঙ্গ, এই আশঙ্কা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)