বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কারণ হিসাবে বিষয়টি এমনই নতুন এবং অপ্রত্যাশিত যে, মহারাষ্ট্রের মুর্তিজ়াপুরের ঘটনাটি সংবাদপত্রের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে। সেখানে পাত্রী তাঁর হবু স্বামীর ‘সিবিল স্কোর’ দেখতে চান। দেখা যায়, সেই পাত্রের বহু ঋণ রয়েছে, তার মধ্যে একাধিক ঋণ অনাদায়ি। এমন পাত্রকে বিয়ে করতে রাজি হননি মেয়েটি। ঘটনাটির তাৎপর্য কতখানি, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরটির দৈর্ঘ্য থেকে অবশ্য তা অনুমান করা যাবে না। এক কালে রেডিয়ো-টেলিভিশনে সরকারি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হত— বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর ঠিকুজি-কোষ্ঠী দেখার বদলে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট দেখুন। এইচআইভি-এডস হোক থ্যালাসেমিয়া, বিবাহসূত্রে যেন রোগ না-ছড়ায়, তা নিশ্চিত করার জন্যই প্রয়োজন হয়েছিল এই বিজ্ঞাপনের। একটি নতুন বিজ্ঞাপন দেওয়া যেতেই পারে— রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টের সঙ্গে পাত্র বা পাত্রীর ক্রেডিট রেটিং রিপোর্টও দেখে নিন। কারণ, বিবাহ নামক প্রত্যাশিত দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে প্রবেশ করার সময় যেমন এটা জেনে নেওয়া জরুরি যে, ঠিক কতখানি বকেয়া ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সংসার শুরু করতে হবে; তেমনই এটাও জানা দরকার যে, সম্পর্কের উল্টো দিকে থাকা মানুষটির আর্থিক দায়িত্বজ্ঞান কতখানি। ঘটনা যে, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ গ্রহণ না করলে কারও ক্রেডিট রেটিং তৈরি হয় না— ফলে, সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের জন্য এই পরীক্ষাটি প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু, যাঁদের জন্য প্রযোজ্য, তাঁরাও যদি সূত্রটি ব্যবহার করতে পারেন, তবে ভবিষ্যতের বহু সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে।
মহারাষ্ট্রের যে মেয়েটি ক্রেডিট রেটিং-এর কারণে বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন, তিনি নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ভাবে সাক্ষর— এমন একটি গুণ, যা দুর্ভাগ্যবশত ভারতে এখনও সুলভ নয়। এমনকি নিতান্ত প্রাথমিক আর্থিক জ্ঞানও বহু মানুষেরই নেই। বিবাহসম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সেই জ্ঞানের অভাব থেকে বহুবিধ সমস্যার সূত্রপাত হতে পারে। ভারতের মতো দেশে কথাটি মেয়েদের ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি করে প্রযোজ্য। কারণ, কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান দেখলেই স্পষ্ট যে, অধিকাংশ মেয়েই এখনও অর্থকরী কর্মসংস্থানে নিযুক্ত হন না— ছবিটি এমনই যে, অমৃতকালের ছবি আঁকতে বসেও অর্থমন্ত্রী ৭৫ শতাংশের বেশি মেয়ের কর্মসংস্থানের কথা বলতে ভরসা করেন না। ফলে, আর্থিক ভাবে দেশের সিংহভাগ বিবাহিত মেয়ে এখনও তাঁদের স্বামীর উপরে নির্ভরশীল। তিনি কতখানি ঋণে নিমজ্জিত, অথবা আর্থিক ভাবে কতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন, বিবাহ-পূর্ব অবস্থায় সে কথা বোঝার কোনও ‘স্বাভাবিক’ উপায় নেই— বাড়িঘর দেখে, আত্মীয়পরিজন বা পাড়াপড়শির সঙ্গে কথা বলে পুরো ছবিটি বোঝা যাবে, সে নিশ্চয়তা নেই। এই অবস্থায় ‘ক্রেডিট রেটিং’-এর যে ব্যবহার মহারাষ্ট্রের মেয়েটি করেছেন, তা বাজারসিদ্ধ পদ্ধতি। কোনও আর্থিক সংস্থা কাউকে ঋণ দেওয়ার আগে তাঁর ঋণযোগ্যতা বিচার করার জন্য ক্রেডিট রেটিং-ই দেখে। প্রশ্ন হল, আর্থিক সাক্ষরতা বা বিবাহ-পূর্ব আর্থিক যাচাইয়ের গুরুত্ব কি প্রত্যেককে ঠেকে শিখতে হবে? জনস্বার্থেই এই সচেতনতার প্রসার প্রয়োজন। এবং, তার গুরুত্ব শুধু বিবাহের ক্ষেত্রেই নয়, কার্যত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। নাগরিকের মধ্যে আর্থিক সচেতনতা প্রসার ও বৃদ্ধির দায়িত্বটি যে একবিংশ শতকের রাষ্ট্রকে নিতেই হবে, সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।