ডেঙ্গির মরসুম এলে ব্যবস্থা করা নয়, বরং সারা বছর ডেঙ্গি দমনে তৎপরতা দেখালে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকে এই রোগ— বিশেষজ্ঞদের এই সতর্কবার্তা সাম্প্রতিক কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে বহু আলোচিত। গ্রীষ্মকাল সমাগতপ্রায়। এই সময়ের কয়েক পশলার অকালবৃষ্টি মশার আঁতুড়ঘরগুলিকে রসদ জোগায়। রোগও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে বর্ষার মাঝামাঝি চরম রূপ ধারণ করে, চলে শীতের গোড়া পর্যন্ত। সুতরাং, ডেঙ্গি দমনে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হলে এটাই আদর্শ সময়। এবং সেই কাজে শুধুমাত্র যে পুরপ্রশাসনের তৎপরতা প্রদর্শনই যথেষ্ট নয়, বরং প্রশাসনের অন্য দফতরগুলিকেও সতর্ক থাকতে হবে, সেই বোধটি বিলম্বে হলেও রাজ্য প্রশাসনের জাগ্রত হয়েছে। যেমন সম্প্রতি রাজ্যের শিক্ষা দফতর একটি নির্দেশিকা পাঠিয়েছে স্কুলগুলিতে। বলা হয়েছে— কোনও অবস্থাতেই স্কুলে জল জমতে দেওয়া যাবে না। নিয়মিত স্কুল চত্বর পরিষ্কার রাখা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে নজরদারি চালানোর দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের। ঝড়-বৃষ্টিতে নিকাশি নালা বন্ধ হয়ে চত্বরে কোথাও জল জমছে কি না, চৌবাচ্চা বা জলের ট্যাঙ্ক থাকলে তা নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে কি না, তা নজরদারির আওতায় আনতে হবে, প্রয়োজনে সাফাইকর্মীদের দিয়ে তা পরিষ্কার করিয়ে নিতে হবে। সর্বোপরি, এই কাজে শিক্ষার্থীরাও যেন ক্লাসের ফাঁকে অংশগ্রহণ করে, তা-ও দেখতে হবে শিক্ষকদেরই।
এই উদ্যোগ সদর্থক। বিশেষত বিদ্যালয় পরিষ্কার রাখার কাজে শিশুদের নিয়োগের বিষয়টি। নিজেদের ‘দ্বিতীয় গৃহ’টির পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব যে তাদের উপরেও বর্তায়, শিশুবয়স থেকে সেই বোধ জাগ্রত করা হলে পরবর্তী জীবনে তা তাদেরই কাজে আসবে। কিন্তু পরিচ্ছন্নতার কাজটি যেন তাদের দৈনন্দিন পঠনপাঠনের ক্ষতি করতে না পারে, সে দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। অন্য দিকে, যে কাজ সাফাইকর্মীর জন্য নির্ধারিত, সেই কাজে শিশুদের নিয়োগের প্রবণতা যেন দেখা না দেয়, নিশ্চিত করতে হবে তা-ও। কর্নাটকের এক স্কুলে একদা শিক্ষার্থীদের দিয়ে শৌচাগার পরিষ্কারের কাজ করানো হয়েছিল। এই কাজ অমানবিক এবং শিশুর অধিকার বিরোধী। বরং তাদের দিয়ে সচেতনতা প্রচারের কাজটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার ভাবনাটি যথাযথ। বিদ্যালয় শুধুমাত্র কিছু ক্ষণের বিদ্যাচর্চার জায়গাই নয়। বৃহদর্থে তার একটি সামাজিক ভূমিকাও রয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সামাজিক প্রয়োজনে শিক্ষকদের এগিয়ে আসার উদাহরণ পাওয়া যায়। ডেঙ্গির মতো জটিল রোগের মোকাবিলায় ফের বিদ্যালয়গুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে আখেরে সমাজেরই লাভ।
কিন্তু এখানে একটি অন্য প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন। যে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে, তা শুধুমাত্র ডেঙ্গিদমন কর্মসূচি নয়, বরং বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিচ্ছন্নতা রক্ষার বিষয়টির উপরেই আলোকপাত করে। এই কাজে এত দিন সরকারি দৃষ্টি পড়েনি কেন? বিদ্যালয়গুলিতে শৌচাগার পরিষ্কারের কথা বলা হয়েছে। কতগুলি সরকারি এবং সরকারপোষিত স্কুলের ভদ্রস্থ শৌচাগার রয়েছে? বিশেষত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যালয়গুলিতে অপরিচ্ছন্ন শৌচাগার, জলের ব্যবস্থা না থাকার উদাহরণ সুপ্রচুর। সেগুলি শুধুমাত্র ডেঙ্গি নয়, বিভিন্ন রোগের আঁতুড়ঘর হয়ে বিরাজ করে। মেয়েদের নানাবিধ জটিল সংক্রমণের শিকার হতে হয় এই শৌচাগারের কল্যাণেই। বহু বিদ্যালয়ে উপযুক্ত শ্রেণিকক্ষ নেই, একটিমাত্র ঘরে গাদাগাদি করে একাধিক শ্রেণির পঠনপাঠন চলে, যা আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বর্ষার দিনে ছাদ দিয়ে জল পড়ে বলে পড়াশোনা বন্ধ রাখতে হয়। শহরাঞ্চলে পুরসভা পরিচালিত স্কুলগুলির অবস্থাও তথৈবচ। সেখানে শৌচাগার তৈরির নাম করে পুকুর চুরি চলে। এমতাবস্থায় পরিচ্ছন্নতার এই নির্দেশিকা প্রহসনসদৃশ মনে হয়। ডেঙ্গি দমনে স্কুলগুলিকে শামিল করা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু তার আগে পরিকাঠামোটুকু সংস্কারের অন্তত উদ্যোগ করা হোক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)