Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Polices

প্রকৃত চেহারা

শুধু নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান করার ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনও প্রয়োজনে থানায় গেলেই এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে মাথা কুটে মরাই সাধারণ মানুষের নিয়তি।

প্রভাবশালীর চাপ না থাকলে সাধারণ মানুষের অভিযোগকে পুলিশ পাত্তা দেবে না।

প্রভাবশালীর চাপ না থাকলে সাধারণ মানুষের অভিযোগকে পুলিশ পাত্তা দেবে না।

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৫১
Share: Save:

বাগুইআটির দুই তরুণের অপহরণ ও হত্যামামলায় তদন্তে গাফিলতির অভিযোগে দুই পুলিশ আধিকারিককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সে দোষে কেবল এই দুই পুলিশকর্মীই দুষ্ট, বললে থানার দেওয়ালগুলিও অট্টহাস্যে ফেটে পড়বে। শুধু নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান করার ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনও প্রয়োজনে থানায় গেলেই এক টেবিল থেকে অন্য টেবিল, এ দরজা থেকে অন্য দরজায় মাথা কুটে মরাই যে সাধারণ মানুষের নিয়তি, এ কথা রাজ্যবাসী অভিজ্ঞতায় জানেন। উর্দি, এবং টেবিলের সুবিধাজনক প্রান্তটিতে বসার অধিকার এমনই দাপটের জন্ম দেয় যে, তার সামনে জোড়হস্ত নতমস্তক হয়ে থাকাই দস্তুর। কোনও ক্ষমতাবানের টেলিফোন বা উপরতলার চাপ না এলে সাধারণ মানুষের অভিযোগে পুলিশ এক বারেই নড়ে বসেছে, এমন ঘটনা সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে বলে সম্ভবত কর্তারাও দাবি করবেন না। বিশেষত, কোনও তরুণ বা তরুণীর নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ দায়ের করতে গেলে লিঙ্গসাপেক্ষে পুলিশের বাঁধাধরা উত্তর— মেয়ে প্রেম করে পালিয়েছে, ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করতে গিয়েছে। এই উত্তরের ফাঁক গলে কত মেয়ে যে পাচারের অন্ধকারে হারিয়ে যায়, কত ছেলে বিপন্ন হয়, বাগুইআটির দুই তরুণের প্রাণের মূল্যে সেই কথাটি প্রবল ভাবে জনসমক্ষে এল। অভিজ্ঞতা বলে, নতুনতর সংবাদের ধাক্কায় কথাটি দু’এক দিনের মধ্যে ফের হারিয়েও যাবে। দুই আধিকারিক সাসপেন্ড হওয়ায় বাহিনীর স্বভাব পাল্টাবে, তেমন দুরাশা করতে কারও সাহস হবে কি?

পুলিশের তরফে যে অজুহাতগুলি পেশ করা হয়, তা সুপরিচিত। যেমন, বাহিনীতে কর্মী প্রয়োজনের তুলনায় বড়ই অপ্রতুল, ফলে অভিযোগ পাওয়ামাত্রই সব তদন্তে ঝাঁপিয়ে পড়া সম্ভব হয় না। অথবা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, সত্যিই তরুণ-তরুণীরা প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, অথবা স্বেচ্ছায় কোথাও গিয়েছে, বা নিজেরাই লুকিয়ে থেকে বাড়ির লোকের উপর মুক্তিপণ দেওয়ার চাপ তৈরি করছে। অথবা, অধিকাংশ ‘নিখোঁজ’-ই কয়েক দিন পরে ফিরে আসে। কথাগুলির মধ্যে একেবারে যুক্তি নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত এগুলি অজুহাতই— দায়িত্ব পালন না করার ফিকির। এবং, সব ক্ষেত্রে যে কর্মীর অভাবেই তদন্তে গড়িমসি হয়, তেমন দাবিও করা মুশকিল। প্রশ্নটা আসলে অভ্যাসের— প্রভাবশালীর চাপ না থাকলে সাধারণ মানুষের অভিযোগকে পুলিশ পাত্তা দেবে না, এটাই অভ্যাস। অবশ্য দুর্জনে বলে, কাঞ্চনমূল্যেও অনেক সময় চাপের কাজটি হয়ে যায়। এই অভ্যাসে চললে মাঝেমধ্যে গোলমাল হওয়া স্বাভাবিক, বাগুইআটি কাণ্ডে যেমন হয়েছে।

এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে পুলিশ অতি দক্ষ ভঙ্গিতে নিজের গুণকীর্তন করে থাকে। হৃত মোবাইল ফোন পুনরুদ্ধার করে, অথবা পথভোলা প্রবীণ নাগরিককে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এমন ভঙ্গিতে ফেসবুকে জানায়, যেন সেই কাজগুলি পুলিশের নয়, পিডব্লিউডি-র করার ছিল। তা নিছক যুগধর্ম মেনে আত্মপ্রচার, তেমনটা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। আসলে পুলিশকর্তারা বিলক্ষণ জানেন যে, ভুক্তভোগী নাগরিকের কাছে বাহিনীর স্বরূপটি স্পষ্ট। মাঝেমধ্যে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ফুটবল খেলে, প্রবীণ নাগরিকদের বাজার করে দিয়ে, অথবা দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করে যেমন সেই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢাক পিটিয়েও ঠিক সেই কাজটিই করা হয়। এ যেন গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা— থানায় যে পুলিশকে দেখে, এবং যাদের হাতে নাজেহাল হয়ে মানুষ তিতিবিরক্ত, সেই পুলিশ বাহিনীর আসল রূপ নয়। প্রকৃত চেহারাটি ধামাচাপা দেওয়ার পরিবর্তে কর্তারা যদি বাহিনীর স্বভাব শুধরাতে সচেষ্ট হন, তা হলেই মঙ্গল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Polices Baguiati Students Murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE