পরিবার বা সমাজের কোলাহলের আড়ালে অনেক সময় মাথাচাড়া দেয় মৌলবাদ। কিন্তু সংশোধনাগারের আড়ালে গোপনে কোন মৌলবাদী ভাবধারার চাষ হচ্ছে তা জানা-বোঝা দুষ্কর। সেখানে নজরদারি ও বিধিনিষেধের একটা চিরাচরিত ঘেরাটোপ থাকে বলে কর্তৃপক্ষের একটা আত্মতৃপ্তির ঝুঁকিও থাকে— যেন ওই নিয়মবিধি ঠিকঠাক পালন হলেই হল, কোন কারাবন্দি কাদের সঙ্গে মিশছে, সংশোধনাগারে নতুন আসা বন্দির মগজধোলাই হচ্ছে কি না, তা নিয়ে তাঁরা সব সময় মাথা ঘামান না। এই অসতর্কতার সুযোগেই ঘনাতে পারে মৌলবাদের বিপদ, সতর্ক করল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ভারতের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনকে কেন্দ্র পরামর্শ দিয়েছে সংশোধনাগারের মধ্যে এই দিকটিতে নজর দেওয়ার— মৌলবাদের প্রচারকদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে, প্রয়োজনে পৃথক সংশোধনাগার বা অন্তত আলাদা ওয়র্ড বা উইং তৈরি করে এদের সেখানে সরিয়ে দিতে হবে।
মৌলবাদের বিপদ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে কেন্দ্র তো পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েই খালাস, তার বাস্তবতা ও বাস্তবায়নের ছবিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারতের সংশোধনাগারগুলি উপচে পড়ছে অভিযুক্ত, বিচারাধীন বা দণ্ডিত অপরাধী-সহ নানা স্তরের বন্দিতে, সকলকে জায়গা দেওয়ার জায়গাটুকুও সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই নেই, বন্দিদের ন্যূনতম সুযোগসুবিধা, মানবাধিকার তো দূরস্থান। কারান্তরালের মানসিক পরিবেশটিও দুর্বিষহ, বন্দিদের লড়তে হয় বৈষম্য থেকে একাকিত্ব সব কিছুর সঙ্গেই। এই অসাম্য ও বিচ্ছিন্নতার আবহে মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়া বিচিত্র নয়, সংশোধনাগারের চার দেওয়ালের মধ্যে তার সুযোগও অনেক। বিপুলসংখ্যক বন্দিদের মধ্যে ক’জন কী ভাবে এই বিপজ্জনক প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ছেন তা চিহ্নিত করা অসম্ভব না হলেও কঠিন নিঃসন্দেহে, আরও কঠিন তাঁদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা, ‘মূলস্রোত’ও যেখানে বৈষম্যে আকীর্ণ। কেন্দ্র বলেছে মৌলবাদের উপসর্গ বা লক্ষণ চিহ্নিত করতে এ ধরনের বন্দিদের আচরণের দিকে শুরু থেকেই নজর রাখতে হবে, কিন্তু কারা-কর্মীরা কি সে কাজের জন্য আদৌ প্রশিক্ষিত? ‘কগনিটিভ বিহেভিয়রাল থেরাপি’, মনোবিদ দিয়ে নিয়মিত বন্দিদের কাউন্সেলিং করানোর কেন্দ্রীয় নির্দেশ যতই সঙ্গত হোক, রাজ্য সংশোধনাগারগুলির কি সেই পরিকাঠামো, ব্যয়-বরাদ্দ আছে? মৌলবাদী ভাবাপন্ন বন্দিদের আলাদা সংশোধনাগারে রাখার যুক্তিটি সাদা চোখে সঙ্গত মনে হলেও, সেখানেও ঢের অসঙ্গতি লুকিয়ে— প্রথমত সংশোধনাগার গড়ার পরিকাঠামো নেই, দ্বিতীয়ত, এই বন্দিদের ‘সংশোধন’ করে মূলস্রোতে সংযুক্তির বদলে চিরবিযুক্তিই তবে সরকারের লক্ষ্য?
কেন্দ্র-রাজ্য বনিবনার ব্যাপারটিও এ ক্ষেত্রে জরুরি। কেন্দ্র ও রাজ্যে আলাদা দল ক্ষমতায় থাকলে কেন্দ্রীয় পরামর্শ অনেক সময়ই ধোপে টেকে না, রাজ্যগুলি নিজের নিয়মই বহাল রাখে। এ ক্ষেত্রেও তা হলে অসতর্কতার আড়ালে বিপদ ঘনাতে পারে, কারণ মৌলবাদের লক্ষ্য সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা লঙ্ঘন। আবার মৌলবাদ বলতে কেন্দ্র ঠিক কোন মৌলবাদ বোঝাচ্ছে তা নিয়েও ধন্দ জাগে। উগ্র হিন্দুত্ববাদও কি মৌলবাদের নামান্তর নয়? এই দ্বন্দ্বের ধোঁয়াশা না কাটিয়ে স্রেফ উপর-উপর পদক্ষেপ করলে কি কারান্তরালে সুফল মিলবে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)