E-Paper

কে কত খুশি

রাজ্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির দশা শতছিদ্র ছাতার মতো। এই কি পুজোর রোশনাইয়ে পাঁচশো কোটি টাকা খরচ করার সময়?

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৫ ০৫:০৩

এ বছর পুজোর উদ্যোক্তা ক্লাবগুলিকে এক লক্ষ দশ হাজার টাকা সরকারি সহায়তা দেওয়া হবে, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে এই ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্লাব-কর্তাদের প্রশ্ন করেছেন, “খুশি তো?” প্রশ্নটা মোক্ষম। হাতে-হাতে কিছুমিছু দিয়ে খুশি করার রাজনীতিই করে আসছেন তৃণমূল নেত্রী। তার ফলে বাজেটের মূল স্রোতে, অর্থাৎ পরিকাঠামো এবং পরিষেবার বিধিবদ্ধ খাতে, বরাদ্দ শীর্ণই রয়ে যাচ্ছে, কখনও তা শীর্ণতর হচ্ছে। রাজনীতি তৈরি করছে রাজস্ব ব্যয়ের নতুন নতুন খাত— অনুদান, ভর্তুকি, কর মাফ, জামা-জুতো, মেলা-খেলা। তার কারণটিও স্পষ্ট— সভা করে অনুদান ঘোষণা করলে দাতার চেহারাটা বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। যিনি দিচ্ছেন, তিনি না-ও দিতে পারতেন, দিতে চাইলেন বলেই দিলেন, তা নিয়ে কারও সন্দেহের অবকাশমাত্র থাকে না।এক দিকে না চাইতেই পাওয়ার কৃতজ্ঞতা, অন্য দিকে পেয়েও হারানোর ভয়, এই দুই অনুভূতির জমিতে তৈরি হয় জনমোহিনী রাজনীতি। কন্যাশ্রী, খাদ্যসাথী, কৃষকবন্ধু, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্প তৃণমূলকে ভোট এনেও দিয়েছে। প্রশ্ন ওঠে সরকারের কর্তব্য-সংস্কৃতিতে। টাকার অভাবে প্রশাসনে বহু পদ শূন্য,সেচ বা সড়কের মতো পরিকাঠামো নির্মাণ, মেরামতি স্থগিত রয়েছে। অগণিত সরকারি কর্মী তাঁদের নানা আইনি প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত। রাজ্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির দশা শতছিদ্র ছাতার মতো। এই কি পুজোর রোশনাইয়ে পাঁচশো কোটি টাকা খরচ করার সময়?

এ প্রশ্ন কখনও নবান্নে, কখনও আদালতে, ঠোক্কর খেয়ে ফিরে এসেছে। উত্তর মেলেনি, মিলবেও না। জনমোহিনী রাজনীতির বাঘের পিঠ থেকে নামার উপায় শাসক দলের নেই। বরং যে কোনও বাহুল্যকে সরকারি আধিকারিক হাতসাফাইয়ের খেলায় দেখিয়ে দেবেন ‘একান্ত প্রয়োজন’ বলে। অতএব অকারণ উষ্মায় সময় নষ্ট না করে প্রশ্নটা রাখা যায় অন্য ভাবে— অনুদানের প্রকল্পকে কি অপচয়ী হতেই হবে? তাকে কি প্রান্তিকের সক্ষমতা তৈরির কাজে নতুন নতুন উপায়ে ব্যবহার করা যায় না? আজ যেগুলি উন্নয়ন ও জনকল্যাণের সরকারি প্রকল্প বলে গৃহীত হয়েছে নানা রাজ্যে, তার অনেকগুলির উৎস জনমোহিনী রাজনীতিতে। ১৯৮২ সালে তামিলনাড়ুর একটি গ্রামে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এমজিআর শুরু করেছিলেন মিড-ডে মিল প্রকল্প, পরে তা প্রসারিত হয় সারা রাজ্যে। এটি তাঁর দলকে যেমন বিপুল জনসমর্থন দিয়েছিল, তেমনই শিশুর পুষ্টি এবং পড়াশোনাতেও উন্নতি ঘটিয়েছিল, তা প্রমাণিত। ২০০৬ সালে নীতীশ কুমার ‘মুখ্যমন্ত্রী বালিকা সাইকেল প্রকল্প’ শুরু করায় স্কুলের উপরের ক্লাসে ছাত্রী-সংখ্যা বেড়েছিল। পরবর্তী নির্বাচনে লালু প্রসাদ যাদব মোটরবাইক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তবু জিতেছিলেন নীতীশই। ২০১৩ সালে জয়ললিতা তামিলনাড়ুতে শুরু করেছিলেন সুলভ খাবারের জন্য ‘আম্মা ক্যান্টিন,’ যে মডেল নানা রাজ্যে গৃহীত হয়েছে।

অর্থাৎ, জনমোহিনী রাজনীতি মানেই পরিণামহীন, দেখনদারি-সর্বস্ব ব্যয় কি না, ভাবার সময় এসেছে। দিল্লিতে আপ সরকার জনপ্রিয়তা বাড়াতে খুলেছিল মহল্লা ক্লিনিক, ভোলবদল করেছিল পুরসভার স্কুলগুলির। এগুলিও ভোটবাক্সে ফল দিয়েছে। মমতা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে প্রায় নিলাম হাঁকার মতো বললেন, “কত চাই? নব্বই? পঁচানব্বই? এক?” এর অর্থ কী? করদাতার টাকা কত খরচ হবে, তা কি নির্ধারণ করবে ক্লাব-কর্তাদের চাহিদা? না কি নেত্রীর মর্জি? আসল প্রশ্নটা গোড়ার। যে ‘জন’-কে মোহিত করতে চায় দলীয় রাজনীতি, সে কে? যদি সে হয় প্রান্তিক, অবহেলিত মানুষ, তা হলে খরচ হবে শিক্ষা, চিকিৎসা, পুষ্টিতে। আর যদি তা হয় লুম্পেন জনতা, কিংবা বুথদখলকারী, ভোট-ছিনতাইকারী মানুষ, তা হলে তাৎক্ষণিক ‘খুশি’-র তুবড়িতেই শেষ হবে করদাতার টাকা। দারিদ্রের আঁধার আরও গাঢ় হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Durga Puja TMC Government Schemes

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy