নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে রাতারাতি বিহারের ভোটার তালিকার চরিত্র বদলে গেল। নিবিড় সংশোধনের প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হওয়ার পর ১ অগস্ট কমিশন যে তালিকা আপলোড করেছিল, সেটি ছিল ‘মেশিন রিডেবল’— অর্থাৎ, এমন গোত্রের ফাইল, যাতে কম্পিউটারের মাধ্যমে সার্চ করা সম্ভব, বিভিন্ন সূচক অনুসারে তালিকা তৈরি করা সম্ভব ইত্যাদি। অর্থাৎ, এই গোত্রের ফাইল থেকে কোনও তথ্য, এবং তথ্যের অসঙ্গতি, দ্রুত খুঁজে বার করা যায়। দিন কয়েকের মধ্যেই পাল্টে গেল সেই তালিকার চরিত্র। ‘মেশিন রিডেবল ফরম্যাট’-এর পরিবর্তে কমিশন আপলোড করল তালিকার ছবি, যেখানে কম্পিউটারের মাধ্যমে সার্চ করা যায় না। তার কয়েক দিনের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন আদালতকে জানাল, বিহারে নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ায় কার নাম বাদ পড়ল এবং কেন, তা জানানোর কোনও আইনি বাধ্যবাধকতা কমিশনের নেই। ঘটনাগুলির সঙ্গে রাহুল গান্ধীর সাংবাদিক সম্মেলনের সমাপতন এমনই প্রকট যে, কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে— কর্নাটকের পরে যাতে বিহারের তালিকা নিয়েও এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ না হয়, তা নিশ্চিত করাই উদ্দেশ্য।
কর্নাটকেও নির্বাচন কমিশন রাহুল গান্ধীকে নোটিস পাঠিয়েছে— হয় তিনি যাবতীয় প্রমাণ জমা দিন, অথবা ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কমিশনের অবস্থানে যে ভঙ্গিটি স্পষ্ট, তা হুমকির। এবং, সেই হুমকিটির অভিমুখ শুধু রাহুল গান্ধীর দিকেই, ভাবলে ভুল হবে। বস্তুত, তিনি উপলক্ষ মাত্র— এই অনতিপ্রচ্ছন্ন হুমকিটি দেশের নাগরিক সমাজের প্রতি। কমিশনের সঙ্গে লড়ে যাওয়ার মতো কোমরের জোর একক ব্যক্তিবিশেষ, অথবা নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম বা তথ্য যাচাইকারী সংস্থার না থাকাই স্বাভাবিক। তাঁদের ভয় পাওয়াতেই কমিশনের এ-হেন অবস্থান, কেউ এমন অভিযোগ করলে তা উড়িয়ে দেওয়া যাবে কি? অথচ, ছবিটি ঠিক উল্টো হওয়া উচিত ছিল। রাহুল গান্ধীই হোন বা ভারতের অন্য যে কোনও নাগরিক, দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া বিষয়ে কোনও স্পষ্ট অভিযোগ তুললে তার নিরপেক্ষ তদন্ত করার দায়িত্বও কমিশনের। অভিযোগগুলি তো স্পষ্ট— কর্নাটকের মহাদেবপুরা বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটার তালিকায় ভুয়ো নাম, ভুয়ো ঠিকানা, একই ঠিকানায় কয়েক হাজার ভোটার ইত্যাদি মিলিয়ে মোট এক লক্ষেরও বেশি ভুয়ো ভোটার আছে। এ বিষয়ে তথ্য তো কমিশনের কাছেই থাকার কথা। তথ্যে কোনও অসঙ্গতি থাকলে, তা একটি কেন্দ্রের হলেও কেউ তা কমিশনের নজরে আনতেই পারেন। এবং কমিশনের উচিত তার তথ্যনির্ভর উত্তর দেওয়া বা মীমাংসা করা। তার বদলে কমিশন যে ভূমিকা নিচ্ছে, তা দুর্ভাগ্যজনক।
অবশ্য, এই প্রথম নয়। এ বছরের গোড়ায় রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছিলেন যে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন এবং বছরের শেষে বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে মহারাষ্ট্রে ভোটারসংখ্যা বেড়েছে এক কোটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যানের সঙ্গে এই ভোটার বৃদ্ধির সাযুজ্য নেই। কমিশন অভিযোগটিকে কার্যত গ্রাহ্যই করেনি। সংশয় হওয়া স্বাভাবিক যে, নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক গুরুত্ব বিস্মৃত হয়েছে। সিবিআই-ইডি’র মতো প্রতিষ্ঠান যেমন শাসকের পোষা টিয়ায় পরিণত, নির্বাচন কমিশনেরও সম্ভবত তেমনই ‘উচ্চাশা’। কমিশনকে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, তারা কোনও রাজনৈতিক দল নয়— বিশেষত, তারা কেন্দ্রীয় শাসক দলের শাখা সংগঠন নয়। দেশে গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষার গুরুতর দায়িত্বের অন্যতম ভাগীদার এই প্রতিষ্ঠান। কোন অভিযোগে শাসকপক্ষের অসুবিধা, সে কথা বিবেচনা করা নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। কথাগুলি কমিশনের অজানা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকেই রাজনৈতিক তাঁবে নিয়ে আসার রাষ্ট্রীয় প্রকল্প থেকে প্রতিষ্ঠানকে বাঁচানোর জন্য শিরদাঁড়ার যে দৃঢ়তা প্রয়োজন, আজকের ভারতে তার বড়ই অভাব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)