মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে দূষিত কাশির সিরাপের কারণে ২০ জনেরও বেশি শিশুর মৃত্যু আরও এক বার দেখিয়ে দিল যে, ওষুধের গুণমানে ত্রুটি কী ভাবে অতি সাধারণ চিকিৎসাকেও মারাত্মক ঝুঁকিতে পরিণত করতে পারে। জানা যায়, তামিলনাড়ুর একটি সংস্থার উৎপাদিত ওই কাশির সিরাপে ৪৮.৬% ডাইইথিলিন গ্লাইকল (ডিইজি) ছিল, যেখানে সেটির অনুমোদিত সীমা ০.১ শতাংশেরও কম। এর পরই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ-সহ আরও বেশ কয়েকটি রাজ্যে এই ওষুধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাজারে ওষুধ ছাড়ার আগে সেগুলির গুণমান পরীক্ষা করা হচ্ছে কি না, তার উপর নজর রাখার বিষয়ে সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জারি হয়েছে সতর্কতা। অন্য দিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও দিল্লির কাছে জানতে চেয়েছে যে, সাম্প্রতিক মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত কাশির সিরাপগুলি অন্য দেশে রফতানি করা হয়েছে কি না। উল্লেখ্য, চার বছরের নীচে শিশুদের ক্ষেত্রে কাশি ও ঠান্ডা লাগার ওষুধ দেওয়া অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও মধ্যপ্রদেশে মৃত শিশুদের মধ্যে একাধিকের বয়স তার কম।
বহু সিরাপেই প্রোপিলিন গ্লাইকল দ্রাবক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যৌগটিকে আবার শিল্পক্ষেত্রেও বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়, যাতে উচ্চমাত্রার ডাইইথিলিন গ্লাইকল থাকতে পারে। অন্য দিকে, ওষুধে ব্যবহৃত প্রোপিলিন গ্লাইকলে দূষণকারী পদার্থের মাত্রা অনুমোদিত সীমার নীচে থাকে। যখন শিল্প স্তরের প্রোপিলিন গ্লাইকল ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, অথবা সংশ্লিষ্ট ওষুধ সংস্থা ব্যবহারের আগে দূষণকারী পদার্থের জন্য কাঁচামাল সঠিক ভাবে পরীক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন ডিইজি সিরাপ দূষিত করে ফেলে। সে ক্ষেত্রে এটি মানুষের জন্য বিষাক্ত হয়ে ওঠে। দূষিত কাশির সিরাপ ভারত তো বটেই, দেশের বাইরেও প্রাণ কেড়েছে। ২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের রামনগরে হিমাচল প্রদেশের একটি কোম্পানির তৈরি কাশির সিরাপ খেয়ে কমপক্ষে ১৭ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ভারতে তৈরি দূষিত কাশির সিরাপে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি হয় গাম্বিয়া, উজ়বেকিস্তান এবং ক্যামেরুনে; সে সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভারতে তৈরি কাফ সিরাপ সম্পর্কে বিশ্ব জুড়ে একাধিক সতর্কতা জারি করেছিল। তাতে যে পরিস্থিতি পাল্টায়নি, তার প্রমাণ মিলল।
সাম্প্রতিক কালে ভারতের ওষুধ শিল্প নিজেকে ‘বিশ্বের ফার্মেসি’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাপনা কিন্তু সে কথা বলে না। জানা গিয়েছে যে, ভারতের অনেক ছোট ওষুধ উৎপাদন সংস্থাই সংশোধিত গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি)-এর অধীনে নিজেদের নিবন্ধিত করেনি। সেই সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরীক্ষা ব্যবস্থাগুলিও অনিয়মিত এবং ভরসাজনক নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। এতে শুধু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতাই নয়, নিরাপদ প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির অনীহার বিষয়টিও প্রকট হয়ে ওঠে। সরকারের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, দেশের ওষুধ শিল্পের সাফল্য শুধু সস্তা জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনের উপরে নির্ভর করে না, তা দেশে উৎপাদিত ওষুধের বিশ্বাসযোগ্যতার দ্বারাও সমর্থিত হওয়া প্রয়োজন। নচেৎ, এই ধরনের দুর্ঘটনা জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করে— যা যে কোনও ওষুধের সাফল্যের অন্যতম উপাদান। মানুষের জীবন-মরণের বিষয় যেখানে জড়িয়ে, সেখানে ন্যূনতম গাফিলতিটুকুও চলে কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)