E-Paper

এ রাজ্যের অসম্মান

বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার সংখ্যালঘু সমাজের প্রতি অতিরিক্ত নমনীয়তা দেখায়, এই অভিযোগ কান না পাতলেও শোনা যায়। এই ঘটনায় যদি কোনও পক্ষ জয়ী হয়, তবে তা বিজেপি, অন্য কেউ নয়। কেননা, এতে অনুদার অসহিষ্ণু হিন্দুত্বের বক্তব্যই এক ভাবে সমর্থিত হল।

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:৩১

কোনও কোনও ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা অপারগতার কোনও ক্ষমা নেই, হতে পারে না। রাজ্য উর্দু অ্যাকাডেমিতে উর্দু সাহিত্যের অনুষ্ঠানে জাভেদ আখতারের আমন্ত্রণ বাতিল— সেই রকম একটি ক্ষেত্র। তাঁর মতো সম্মাননীয়, উদারমনস্ক কবি ও গীতিকারের বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত, এতে কেবল উর্দু অ্যাকাডেমির ক্ষতি নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গেরই এক ঐতিহাসিক ক্ষত তৈরি হল। যে-হেতু এই অ্যাকাডেমি সরকারি প্রতিষ্ঠান, এই ক্ষত তৈরির দায়িত্ব সরাসরি বর্তায় রাজ্য সরকারের উপর। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর মুখপাত্ররা কোনও ‘অনিবার্য কারণ’ না দর্শিয়ে সরাসরি স্বীকার করুন, রাজ্যের কট্টরভাবাপন্ন উর্দুভাষী মুসলমান গোষ্ঠী— সহজ ভাষায় যাদের মৌলবাদী বলা হয়— তাদের তুষ্ট রাখার জন্যই এই পশ্চাদপসরণ। জাভেদ আখতার নিজেকে নাস্তিক বলেন বলেই তাঁর বিরুদ্ধে এই ‘ফতোয়া’, অথচ নাস্তিকতার সঙ্গে ভাষা-সংস্কৃতির কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। এই কথাটি বলার মতো লোক, কিংবা এই কথাটি এই বিশেষ গোষ্ঠীগুলির মুখের উপর বলার মতো লোক এই সরকারে নেই। হিন্দু সংখ্যাগুরু সমাজ যখন ধর্মভাবনার সঙ্গে ভাষাপরিচিতিকে মিশিয়ে গুলিয়ে দেয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতে পারে, কিন্তু এই একই কাজ যখন মৌলবাদী মুসলিম সমাজ করে, তাদের গরল উৎপাদনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো কেউ এই সরকারে নেই। সংখ্যালঘু ভাবাবেগের নামে মৌলবাদের আবেগ রক্ষা করল সেই মুখ্যমন্ত্রীরই অধীন প্রতিষ্ঠান, ক্ষণে ক্ষণে যিনি মৌলবাদ-বিরোধিতার প্রতিশ্রুতি শোনান, সংখ্যালঘুর প্রতি দায়িত্ববোধের কথা শোনান।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত আরওই বিপজ্জনক। বিজেপি-আরএসএস কার্যক্রমে রাজ্যের পরিবেশ এখন ধর্মের প্রশ্নে ক্রমশই তিক্ত-বিভক্ত। তার মধ্যে সরকার নিজের মুখে ঘন কালিমা লেপন করল। ইতিমধ্যেই নানা কারণে বিপন্ন সংখ্যালঘু সমাজকে গভীরতর বিপদের মুখে ঠেলে দিল। উদারমনোভাবাপন্ন সহিষ্ণু সমাজের বিরুদ্ধে গর্জাতে থাকা সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতির আক্রমণ উগ্রতর করে দিল। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সংখ্যালঘু তোষণ নিয়ে সাম্প্রতিক কালে বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস— সমস্ত বিরোধী দলই একমত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার সংখ্যালঘু সমাজের প্রতি অতিরিক্ত নমনীয়তা দেখায়, এই অভিযোগ কান না পাতলেও শোনা যায়। এই ঘটনায় যদি কোনও পক্ষ জয়ী হয়, তবে তা বিজেপি, অন্য কেউ নয়। কেননা, এতে অনুদার অসহিষ্ণু হিন্দুত্বের বক্তব্যই এক ভাবে সমর্থিত হল। বিপুল দুর্ভাগ্য এই রাজ্যের উদার সহনশীল সংস্কৃতির— রাজনীতির কোপে যে সংস্কৃতি ইতিমধ্যেই ক্ষীয়মাণ।

কোনও পূর্ব ঘটনার অনুষঙ্গ বা তুলনা দিয়ে বর্তমান ঘটনার বিচার করা অন্যায়। বামফ্রন্ট আমলে ২০০৭ সালে তসলিমা নাসরিনের বইয়ের বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজের মৌলবাদ-প্রভাবিত এক বড় অংশ উত্তাল হয়ে ওঠে, দাঙ্গা পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়। তৎকালীন রাজ্য সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে লেখিকাকে রাতারাতি গোপনে রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত, জাভেদ আখতারের আমন্ত্রণ নিয়ে কিন্তু বাইরে কোনও উত্তপ্ত পরিস্থিতি হয়নি, কেবল তৃণমূল সরকারের অভ্যন্তরে সেই দলের গোঁড়া মুসলমান নেতারা তাঁকে নিয়ে ক্রোধ ও আপত্তি প্রকাশ করেছেন। নিজের সরকারে এই গোষ্ঠীর শক্তি এত প্রবল হয়ে উঠল কেন, তার উত্তর দেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তদুপরি, বাঙালি মুসলমানের হয়ে এই উর্দুভাষী মুসলিম ‘অভিভাবক’দের কেন প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেওয়া হচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমান যখন ঘরে-বাইরে চরম হেনস্থার শিকার, তখন অনধিকারী অভিভাবকদের চোখরাঙানি আর রাজনীতির স্বার্থসন্ধানে বাংলাভাষী মুসলমানের স্বার্থ বিপন্ন হচ্ছে। আর বিপন্ন হচ্ছে উদার সংস্কৃতির ঐতিহ্য, জাভেদ আখতার যার প্রতিনিধি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP Minority West Bengal Urdu Academy Culture

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy