হাতে হাতকড়া, পায়ে শিকল। সম্প্রতি এমন অমানবিক ভাবেই শতাধিক ভারতীয়কে অমৃতসর ফেরত পাঠাল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনে জিতে সেই প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করলেন তিনি। প্রতিশ্রুতি রক্ষার পদ্ধতিটি তাঁর স্বভাবোচিত ভাবেই নিয়মনীতির তোয়াক্কাহীন, অ-ভদ্র। ভারতীয়রা স্বদেশে ফিরলেন দাগী অপরাধীর মতো। অন্য দিকে, রাজ্যসভায় বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দাবি করলেন যে, প্রত্যেক দেশেরই অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর অধিকার রয়েছে। দেশের এই অসম্মানের সামনে কার্যত ট্রাম্প সরকারের হাতকড়া-শিকলের সাফাই দিলেন ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী। বেসরকারি উড়ানের বদলে সি-১৭ গ্লোবমাস্টার সামরিক পরিবহণ বিমান ব্যবহার করা হলেও এ ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়র (এসওপি) মানা হয়েছে বলে জয়শঙ্কর দাবি করলেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, নিজের দেশের অভিবাসীদের মর্যাদাকে গুরুত্ব না দিয়ে তবে কি আমেরিকার অভিবাসন নীতিকে ঢাকতেই ব্যস্ত ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী?
অধিক অর্থ ব্যয়ে সামরিক বিমানে অবৈধবাসীদের ফেরত পাঠানোর একমাত্র উদ্দেশ্য, দৃষ্টান্ত স্থাপন। ট্রাম্প আসলে গোটা দুনিয়াকে এক কঠোর বার্তা দিতে চান। লক্ষণীয়, অবৈধ অভিবাসীদের বহু কাল ধরেই ‘অপরাধী’ আখ্যা দিয়ে আসছেন ট্রাম্প। অথচ, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকনমিক রিসার্চ এবং আমেরিকারই একাধিক প্রদেশের তথ্য অনুযায়ী, এই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক অপরাধের নজির সামান্যই। ট্রাম্প সরকার অভিবাসন আইন দৃঢ় ভাবে প্রয়োগ করতেই পারে, কিন্তু অভিবাসনকে এমন ঘৃণ্য বা হিংস্র অপরাধের সঙ্গে তুলনা করা যায় কি না, সে প্রশ্নের উত্তর তাদের দিতে হবে। বিশেষত আমেরিকার মতো দেশে, যেখানে সে দেশেরই বহু অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই অনথিভুক্ত অভিবাসীদের এ ভাবে বিতাড়িত করলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এত দূর অমানবিকতার দৃষ্টান্ত না দিয়েও তাঁদের নতুন নীতি তাঁরা প্রয়োগ করতে পারতেন, সুতরাং এই অমানবিকতার প্রদর্শনের পিছনে রাজনৈতিক প্রয়োজনটিই বেশি। একটি প্রয়োজন, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ (মাগা) সমর্থকদের কাছে নিজের ওজন বৃদ্ধি। অন্য প্রয়োজনটি সম্ভবত, ভারত যে ভবিষ্যতে কোনও বাড়তি সুবিধা পাবে না, তার ইঙ্গিত প্রদান।
ভারত সরকারের আচরণও কম বিস্ময়কর নয়। যেখানে কলম্বিয়ার মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্র আমেরিকার কাছে তার অভিবাসীদের সঙ্গে মানবিক আচরণের দাবি তুলতে পারছে, সেখানে ভারত কেন দৃঢ়তা দেখাতে পারে না? তবে কি ভারতীয় দ্রব্যের উপর উচ্চ শুল্ক-সহ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কায় মৌনব্রত অবলম্বন করল দিল্লি? দেশের মানুষের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বটি কিন্তু রাষ্ট্রেরই, এমনকি অভিবাসনসূত্রে যাঁরা ভিন দেশে অবস্থিত, তাঁদেরও দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। অভিবাসনেচ্ছুদের বিষয়েও রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে, কেন এতখানি ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা অন্য দেশে যেতে ব্যাকুল? ট্রাম্প সরকারের পক্ষে যুক্তি সাজানোর অপেক্ষা সেগুলি অনেক বেশি মানবিক এবং জরুরি কাজ।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)