এ বার আর সুদূর উত্তরাখণ্ড কিংবা হিমাচল প্রদেশ নয়, খাস কলকাতা মহানগর। আকাশভাঙা অতিবৃষ্টিতে অতিপ্লাবিত প্রায় সমগ্র কলকাতা শহর। বর্ষা চলে যাওয়ার সময় এসেছে, আশ্বিনে দেবীপক্ষ সমাগত, এমন সময়ে ভয়াবহ বৃষ্টির দাপটে আবারও প্রমাণিত হল, কতটাই দুর্বল ও অকেজো এই মহানগরের নিকাশি পরিকাঠামো। সন্দেহ নেই, অতি অল্প সময়ে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যেকার রাতটি জুড়ে (এক রাতে ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতকে অভূতপূর্ব বলা চলে), তাতে দেশের যে কোনও শহরই জলপ্লাবিত হত। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রবল বৃষ্টির ধাক্কায় দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই আজকালমাঝেমধ্যেই অচল হয়ে যায়। এ বারের সঙ্কটের তীব্রতায় কলকাতার দুর্গতিও সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে আরও একটি কথা: অন্তত দশ জন মানুষ জলমগ্ন শহর ও শহরতলিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারালেন সে দিন। এবং এখানেই প্রকৃতির দুর্যোগের সঙ্গে মেশে মানুষের দায়দায়িত্বের স্খলন। বৃষ্টির ফলে বিদ্যুৎপ্রবাহী তারের এই সংযোগ-সঙ্কটের সম্ভাবনা মনে রেখে যে দায়িত্বটি পালন করার ছিল এই রাজ্যের প্রশাসনের, কিংবা এই অঞ্চলে বিদ্যুৎ পরিবহণের ভারপ্রাপ্ত সংস্থার— স্পষ্টতই তা পালিত হয়নি। কথায় কথায় বিদেশি অনুষঙ্গ টেনে আনেন যে প্রশাসনিক শীর্ষ কর্ত্রী, তিনি কি উদাহরণ দেখাতে পারবেন যে কোন উন্নত দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিয়মিত এমন মৃত্যু ঘটে থাকে? কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু এমন মৃত্যু নিয়মিতই। আমপান থেকে ইয়াস, প্রতিটি বিপর্যয়ে এমন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মৃত্যুর ঘটনা দেখেছে এই রাজ্য। যখন বর্ষা না কাটতেই এ বার পঞ্জিকায় শারদ উৎসব সমাগত, রাস্তাঘাট জোড়া বিদ্যুৎ পরিবাহী পরিকাঠামোর সুরক্ষায় কিবাড়তি নজর প্রয়োজন ছিল না? উৎসবে দেদার খরচে অকুণ্ঠ যে মুখ্যমন্ত্রী, দুর্যোগের সম্ভাবনায় মানুষের প্রাণরক্ষার আগামব্যবস্থায় মন দিতে তাঁর এতই অনীহা? ঘটনা ও দুর্ঘটনার চরিত্রই দেখিয়ে দিচ্ছে, প্রকৃতির দুর্যোগ এবং প্রশাসনের দায়িত্বস্খলন, দু’টি প্রশ্নই সমান গুরুতর।
অন্য একটি কারণেও প্রশাসনের দায়িত্বের কথা ওঠে। গঙ্গাতীরবর্তী নিম্ন-অববাহিকাস্থিত নরম পলিমাটি-ভিত্তিক এই মহানগর প্রশাসনিক ও নাগরিক অবিমৃশ্যকারিতায় অতিদ্রুত কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে, জলাভূমি বুজিয়ে কিংবা জলক্ষেত্রগুলিকে আবর্জনা-স্তূপে অপরিবাহী হতে দিচ্ছে। আজ কি তারই খেসারত দিতে হচ্ছে না মহানগরকে? বিশেষজ্ঞদের হিসাব: গত তিন দশকে এই শহরে জলাজমির পরিমাণ কমেছে ৩৬%। জলাজমি শহরের ‘কিডনি’-সমান, তরল বর্জ্যকে প্রাকৃতিক উপায়ে পরিশোধিত করার উপায়, তাই তাকে বিনাশ করার মতো বিপজ্জনক অদূরদর্শিতা আর হয় না। বাড়তি বৃষ্টির ধাক্কায় জমা জল দ্রুত শহর থেকে বার করার পুরনো ব্যবস্থা লুপ্ত, নতুন পরিকাঠামোও যথেষ্ট নয়। অথচ জল জমবে ধরে নিয়ে জল সরিয়ে বিপর্যয় মোকাবিলার উপযুক্ত ব্যবস্থা কেন করা যাবে না? এই সব প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন?
প্রশ্নের উত্তরের দায় তাঁর দিকে ধেয়ে আসবে, খেয়াল রেখেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবিশ্রান্ত ভাবে অভিযোগবাণ নিক্ষেপ করে চলেছেন, একের পর এক কল্পিত ও বাস্তব প্রতিপক্ষের দিকে: সিইএসসি, ডিভিসি থেকে শুরু করে প্রতিবেশী দেশ পর্যন্ত। অথচ এ কোনও রাজনৈতিক ছেলেখেলার সময় নয়, অভিযোগ ছোড়াছুড়ির দক্ষতার পরীক্ষা নয়, বরং সমস্ত উদ্যম ও মনোযোগ একত্র নিবদ্ধ করে মহানগরকে উদ্ধার করার সময়। একই কথা বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকেও বলার থাকে। সরকারবিরোধিতা গত কালও ছিল, আগামী কালও থাকবে। আজকে তাঁদের যেটুকু সংগঠন ও সম্পদ আছে, তা দিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে নাগরিক সঙ্কট মোচনের প্রয়াস করা যায় না কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)