যে দেবী সর্বভূতে মাতৃরূপে বিরাজ করছেন, তাঁকেই দুর্গা বলেছে শাস্ত্র। অতি-শৈশবে নিজের মায়ের অপরিসীম শক্তি, জ্ঞান, কারুণ্যের যে ধারণা জন্মায় সন্তানের মধ্যে, ধর্মশাস্ত্র, সাহিত্য-সঙ্গীত যেন তাকেই আরোপ করে জগজ্জননীর কল্পনায়। তিনি জগৎপ্রসবিনী, জগদ্ধাত্রী, সন্তানকে দশ হাত দিয়ে রক্ষা করেন, ঘোর শত্রুকেও বিনাশ করেন সন্তানের কল্যাণে। তাঁর মধ্যে ক্ষুদ্রতা, স্বার্থ-সঙ্কীর্ণতা, মনুষ্যসুলভ রিপুগুলির কোনওটিই নেই। প্রায় সব সভ্যতা-সংস্কৃতিতে মাতৃত্বের কল্পনায় এমন অসীম দয়া, অবিমিশ্র বাৎসল্যের চিত্র পাওয়া যায়। মাতৃত্বের এই ‘মিথ’ বা কল্পকাহিনি এতই শক্তিশালী সমাজ তা বাস্তবে আরোপ করতে চায় মেয়েদের উপরে। মেয়েরাও নিজেদের বিচার করে মাতৃত্বকে কেন্দ্রে রেখে। সন্তানের জন্য আত্মবিলুপ্তির আদর্শকে প্রাধান্য দেয়। প্রাণী-বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান অবশ্য বলে অন্য কথা। প্রাণী-জগৎ হোক কিংবা মানবসমাজ, সর্বত্র মা আর শিশুর সম্পর্কেও সমাজবদ্ধ জীবনের নানা জটিলতা থাকে পুরো মাত্রায়। মাতৃত্বের আবেগ কখন কাজ করবে, কখন মা সদ্যোজাত সন্তানের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে, তা স্থির করে সমাজ। মহাভারতে সদ্যোজাত পুত্রকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন রাজকন্যা কুন্তী, অপ্সরা মেনকা অরণ্যে পরিত্যাগ করেছিলেন তাঁর শিশু কন্যাকে। আজ যখন প্রযুক্তি নানা বিকল্প উপায়ে প্রজননকে সম্ভব করেছে, তখন ‘সারোগেট’ বা গর্ভদানকারী মাকে নিজের আবেগে রাশ টানতে হয়।
সহজে ভোলা যায় না নোবেলজয়ী সাহিত্যিক পার্ল এস বাক-এর দ্য গুড আর্থ উপন্যাসের সেই কৃষক-পত্নীকে, যে দুর্ভিক্ষের সময়ে সন্তানের জন্ম দিয়ে, নিজেই তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এই প্রবণতা দেখা যায় যুদ্ধের অস্থিরতার সময়েও। বলিভিয়া এবং প্যারাগুয়ের মধ্যে চাকো যুদ্ধ (১৯৩২-৩৫) চলাকালীন বহু মা শিশুদের হত্যা করেছিলেন, জেনেছেন গবেষকরা। যখন খাদ্য নিরাপত্তা সুলভ ছিল না, পরিবার পরিকল্পনার উপায় আবিষ্কৃত হয়নি, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প ভবিষ্যতের গর্ভে, তখন পরিবারের অতিরিক্ত, অবাঞ্ছিত শিশুদের হত্যার কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বহু জননীকে। আরও বহু মা সরাসরি হত্যা না করেও, কেবল অবহেলা, অনাদরে শিশুর মৃত্যুর কারণ হয়েছেন— বিশেষত যখন সে সন্তানটি কন্যা। চিন এবং ভারতে গত কয়েক দশকের ইতিহাস কার্যত কন্যাশিশুর সংখ্যাহ্রাসের ইতিহাস— কখনও গর্ভেই বিনষ্ট হয়েছে মেয়েরা, কখনও জন্মের পরে। মাতৃস্নেহ এই শিশুকন্যাদের জীবনে অমৃতধারা হয়ে নেমে আসেনি। আরও লক্ষণীয়, চিন বা ভারতের মায়েরা যে কন্যাসন্তান-হত্যায় প্রতিবাদ করেছে, এমনও নয়। বরং বাকি সমাজের সঙ্গে মেয়েরাও তা গোপন করেছে। জনসংখ্যায় লিঙ্গের হিসাব গরমিলে তা প্রকাশিত হওয়ার পর সরব হয়েছেন নারীবাদীরা। মাতৃত্বের শক্তি-মাধুর্য কি তবে অনেকাংশেই সমাজের নির্মাণ?
আবার এর বিপরীতও সত্য— জন্মদাতা মা-বাবার বাইরেও যে কোনও নারী বা পুরুষ এক সদ্যোজাতকে মাতৃস্নেহে বড় করতে পারে। এমনকি পৃথক প্রজাতির মা-সন্তানের মধ্যেও এই স্নেহসম্পর্ক দেখা যায়। রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর গল্পের নেকড়ে-পালিত মনুষ্যশিশু সেই সত্যকে নিয়ে রচিত রূপকথা। কিন্তু আধুনিক সমাজে ‘পরিবার’-এর সংজ্ঞা ভেঙেচুরে গিয়েছে, বিস্তৃত হয়েছে। প্রায়ই দেখা যায়, সন্তানকে বড় করছেন একক মা, তাঁর পাশে রয়েছেন আরও কয়েকজন মেয়ে ও পুরুষ। মাতৃত্বের আধুনিক সংজ্ঞা বলে, শিশুর নিয়ত পরিচর্যা, তাকে আগলে রাখা, লালন-পালন, শরীরে-মনে তার বেড়ে ওঠার আনন্দের নিত্য ভাগীদারি যদি ‘মাতৃত্ব’ হয়, তবে তা কেবল নারীতেই সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? বহু পুরুষ সে দায়িত্ব পালন করে সেই অমৃতস্বাদ গ্রহণ করছেন। বাবাদেরও ‘মা’ হয়ে ওঠায় কোনও বাধা নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)