রাজ্যের শিক্ষা দফতরের সামনে বিক্ষোভরত চাকরিহারা শিক্ষকদের উপর পুলিশি নিগ্রহের ছবি ক্ষুব্ধ, বিষণ্ণ করেছে এ রাজ্যের প্রতিটি নাগরিককে। পুলিশের লাথি, লাঠি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন শিক্ষকরা, পুলিশ ও শাসক দলের নেতা-কর্মীদের আক্রমণের মুখে তাঁরা পালটা ইট-পাটকেল ছুড়ছেন, মহিলারা ভেঙে পড়ছেন কান্নায়— এই দৃশ্যগুলির অভিঘাত সুদূরপ্রসারী। নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য নানা ধরনের মানুষ রাস্তায় নামেন, কিন্তু সমাজে শিক্ষকদের স্থানটি বিশিষ্ট। রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণে তাঁরা দৈহিক ভাবে আহত বলে তা গোটা সমাজকে বিচলিত করে। শিক্ষকদের প্রতি ব্যবহারে তাই রাষ্ট্র বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকবে, সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কসবার ডিআই অফিস, অথবা বিধাননগরে বিকাশ ভবন, দু’টি ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের উপর পুলিশ যে ভাবে হামলা চালাল, তাতে কোনও বিবেচনার ছাপ দেখা গেল না। যে কোনও রাজনৈতিক বিক্ষোভকে ছত্রভঙ্গ করতে যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ, সে ভাবেই লাঠি-লাথি চালাল। এমনকি, শাসক দলের নেতা-কর্মীদের হেলমেট-হাতে শিক্ষকদের উপর চড়াও হতে দেখেও পুলিশ বাধা দেয়নি, সংবাদের সাক্ষ্য। পুলিশ অবশ্য অভিযোগের আঙুল তুলেছে আন্দোলনকারীদের দিকেই। বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও শিক্ষকরা বিকাশ ভবনের সামনে অবরোধ তোলেননি, তাই যেটুকু বলপ্রয়োগের প্রয়োজন পুলিশ সেটুকুই করেছে— এই হল যুক্তি। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, বলপ্রয়োগের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে দিল কেন পুলিশ-প্রশাসন? চাকরিহারা শিক্ষকরা যে তাঁদের দাবি নিয়ে বিক্ষোভ করতে তৈরি হচ্ছেন, তা অজানা ছিল না। বিকাশ ভবন অবরুদ্ধ হওয়া, কর্মীরা ভিতরে আটকে পড়ার আগেই কি কোনও জায়গায় বিক্ষোভকারীদের নিবৃত্ত করা যেত না? লাঠি-ঘুষিই কি পুলিশের একমাত্র অস্ত্র? পরিকল্পনার কুশলতা, উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা, এগুলির কি কোনও স্থান নেই?
শিক্ষকরাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নন। বিকাশ ভবনের কর্মীদের সারা রাত আটকে রাখা যদি শিক্ষকদের বিকাশ ভবন অভিযানের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে তা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। আদালতের রায়ের পর তাঁদের পক্ষ থেকে ধৈর্য ও সংযম প্রত্যাশিত। সাধারণ ভাবে, সুস্থ গণতন্ত্রে যে কোনও নাগরিক প্রতিবাদ কর্মসূচির প্রতীকী হওয়ার কথা— প্রত্যাঘাত বা প্রতিশোধের চিন্তার দ্বারা বিক্ষোভ চালিত হলে তা হিংসার পর্যায়ে চলে যায়। তাই চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের প্রতি সহানুভূতি রেখেও বলতে হয়, বিকাশ ভবনকে সারা রাত অবরুদ্ধ করলেও ভাঙচুর আর বলপ্রয়োগের কর্মকাণ্ড কোনও মতেই সমর্থনযোগ্য নয়।
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটির অভিমুখ রাজ্য সরকারের দিকে। চাকরি হারিয়ে মরিয়া শিক্ষকরা আজ শহরের রাস্তায় যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন, তার মূলটি প্রোথিত কোথায়? শিক্ষা দফতরের দুর্নীতি এবং বেনিয়মের পরিমাণ গোটা রাজ্যকে স্তম্ভিত করে রেখেছে। আদালতের রায়ে প্রতিষ্ঠিত, সরকারি শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছিল। তার জেরে চাকরিচ্যুত যোগ্য শিক্ষকদের নিয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থান কী, কোন পথে তাঁদের ফেরানো হবে স্থায়ী নিয়োগে, সে সব ঘোষণা করেনি সরকার। নিয়োগের প্রক্রিয়ায় আস্থা হারিয়েছেন শিক্ষকরা, ফের পরীক্ষায় বসাকে অসম্মানজনক বলে মনে করছেন। এই বিক্ষোভ তাঁদের হতাশার প্রকাশ। এই পরিস্থিতিতে মুখোমুখি বসে আলোচনা, তাঁদের প্রস্তাব শোনা, যথাসম্ভব আশ্বাস দেওয়া, এ সবের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি রাজ্য সরকার। একই মনোভাব স্কুল সার্ভিস কমিশন-প্রকাশিত ২০১৬ সালের ‘অপেক্ষমাণ’ তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের প্রতিও। স্বচ্ছ নিয়ম ও যুক্তির মাধ্যমে সরকারি কাজের দাবিকে সরকার দেখাতে চাইছে ‘প্রতিস্পর্ধা’ হিসেবে। শিক্ষক বা চিকিৎসক, যে কোনও পক্ষ সরব ও সক্রিয় হলেই তাকে চরম প্রতিপক্ষ করে তোলা— এই যথেচ্ছাচার-তন্ত্র আজ পশ্চিমবঙ্গে সুপ্রতিষ্ঠিত।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)