দুর্জনে বলেন, ভারতের মতো দেশে জীবনের দাম নেই। প্রকৃতপক্ষে, সে দাম আছে। সরকারি খাতায় ক্ষতিপূরণের অঙ্কটিই তো দাম! এ দেশে যে কোনও পরিস্থিতিতে কেবল গাফিলতির কারণে গুচ্ছ গুচ্ছ তাজা প্রাণ চলে যাওয়ার পর কারও কিছু আসে যায় না, কেবল নিয়ম করে একটি আর্থিক মূল্য ধরে দেয় সরকার। ‘ক্ষতি’ এই ভাবে সহজেই ‘পূরণ’ করা যায়! আর তাই আবারও কিছু দিন পর আসে একই রকম প্রাণনাশের সংবাদ। চলমান বছরে, একের পর এক পদপিষ্ট মৃত্যুর খবর এসে চলেছে। জানুয়ারিতে অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতি মন্দিরে ছয় জন। ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লির রেল স্টেশনে ভিড়ের চাপে কুম্ভমেলাযাত্রী আঠারো জন। জানুয়ারিতে কুম্ভ-দর্শনে গিয়ে তীর্থযাত্রীর চাপে ত্রিশেরও বেশি। জুন মাসে আইপিএল জয় উদ্যাপনকালীন বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে এগারো জন। সেপ্টেম্বরে তামিলনাড়ুতে একটি সমাবেশ চলাকালীন চল্লিশ জন। এবং শেষতম খবর— নভেম্বরের শুরুতে অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীকাকুলাম জেলায় কাসিবুগ্গায় ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে দশ জনের মৃত্যু। এই রাজ্যও পিছিয়ে নেই। গত মাসেই বর্ধমান স্টেশনে বারো জন প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে একই কাণ্ড। হুড়োহুড়ি, চাপাচাপি, অরাজক পরিস্থিতি, প্রশাসনিক ঔদাসীন্য, ঘটনা-পরবর্তী শোকপ্রকাশ, ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি, সমাধানার্থে দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস— এবং তার পর যে কে সেই। পরবর্তী দুর্ঘটনার জন্য ‘অপেক্ষা’।
একেবারে সাম্প্রতিক কাসিবুগ্গার ঘটনাটিকেই যদি ধরা যায়— এক বিশেষ পুণ্য তিথি উপলক্ষে একই সময়ে বহু মানুষ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিলেন, এ দিকে প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ ছিল একটিই। স্বাভাবিক প্রশ্ন, এমন যে হতে পারে তা নিশ্চয়ই অনুমান-অতীত ছিল না, তবু কেন সতর্কতা নেওয়া গেল না? নির্ধারিত কিছু মানুষ ঢুকবেন, তাঁরা বেরোলে আবার সমসংখ্যক মানুষের পালা, এই ব্যবস্থা করা খুব কি কঠিন? কিংবা, প্রবেশ-প্রস্থানের বিকল্প ব্যবস্থাও কি অসম্ভব? স্বাভাবিক উত্তর, তত্ত্বগত ভাবে কোনও কিছুই কঠিন নয়, কিন্তু প্রয়োগগত ভাবে, অচিন্তনীয়। কেননা চিন্তার সময় বা ইচ্ছা না থাকার কঠিন ব্যারামটিকে সারানো দুষ্কর। এই ব্যারাম এখন ভারতে প্রায় মহামারির স্তরে। সমস্ত তীর্থস্থান-দায়িত্বপ্রাপ্ত গোষ্ঠীই এই অসুখে ভুগছে, এবং বলা বাহুল্য, প্রতিটি সরকার ওই রোগে মৃতপ্রায় অসুস্থ দশায় দিন অতিবাহন করছে।
আরও একটি অসুখের প্রকোপ লক্ষণীয়। সাধারণ নাগরিকের সাধারণ বোধবিলোপের অসুখ। যে সব দুর্ঘটনা হয়েছে, তার অধিকাংশই তীর্থস্থানে। না বলে উপায় নেই, ভিড়ের চাপে প্রাণসংশয় হতে পারে— এই সাধারণ বোধটি বিলোপের সঙ্গে তীর্থস্থান দর্শনের তীব্র অভিলাষের একটি সংযোগ রয়েছে। আর তাই, অবিশ্বাস্য ভাবে এই বিপদের মধ্যে নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং শিশুদেরও ফেলা হয় নিয়মিত, নিরুদ্বেগে। এতখানি দিগ্বিদিকবোধরহিত, কিংবা বেপরোয়া, ভক্তি ভাব ভারতের জনসমাজের একটি বিশিষ্ট চরিত্র। সংখ্যার দিক দিয়ে, তীর্থের পরেই আসে স্টেশন কিংবা পরিবহণ-স্থলে পদপিষ্টের পালা, যার পিছনে স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলা ও অবজ্ঞা অতি সহজেই অনুমেয়। এই পরিব্যাপ্ত উদাসীন জনস্বার্থবিরোধিতার জন্য জনসাধারণই যদি কাউকে দায়ী না করেন, একে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত না করেন, তবে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)