এ যেন আইন অমান্যের উৎসব। পুলিশ, প্রশাসন, আদালতের নির্দেশ, সব নস্যাৎ করে দিল বাজি ফাটানোর উল্লাস। গত কয়েক বছরে দীপাবলির রাতের অভিজ্ঞতার দিকে চেয়ে মনে হয়, এই উন্মত্ততার অন্যথা হবে, তার কোনও সম্ভাবনা কি আদৌ ছিল? এমন কোনও দুরাশা কি কোনও নাগরিকের মনে জন্মেছিল যে, এ বছর আদালতের নির্দেশ মান্য করে রাত দশটার পরে নীরব হয়ে যাবে শহরের সব রাস্তা? হাসপাতালের মতো ‘সাইলেন্ট জ়োন’ বাস্তবিক থাকবে শব্দশূন্য? যারা রাতদুপুরে পিলে-চমকানো শব্দবাজি ফাটাবে, পুলিশের টহল-গাড়ি তাদের দেখতে পেলেই কয়েদ করবে, এমন স্বপ্ন দেখেছিল কেউ? আরও সুদূর একটা সম্ভাবনার কথা ভাবা যাক— দুর্গাপুজোয় পাড়ার যে সব ক্লাব সরকারি অনুদান পাচ্ছে, তার সদস্যরা পাড়ায় বাজি-সম্পর্কিত বিধিনিষেধ প্রচার করছেন, কিশোর-তরুণদের বুঝিয়ে নিবৃত্ত করছেন! কিংবা, শহরের প্রতিটি ওয়র্ডে নির্বাচিত কাউন্সিলর দূষণকারী বাজির বিক্রেতাকে দোকান বন্ধ করতে বাধ্য করছেন! এ সব কল্পনা গড়ে ওঠার আগেই যে ভেঙে পড়তে চায়, তার কারণ বাস্তব আজ হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ— আইনের ভিত্তিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থার নির্মাণ আর হয় না, এখন প্রশাসনের ইচ্ছার উপরে পুঁতে দেওয়া হয় আইনের পতাকা। যেখানে প্রশাসন আইনভঙ্গকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে মদত দেয়, সেখানে বন্যার সামনে বাঁশের সেতুর মতো ভেসে যায় আইনের শাসনের পরিকাঠামো। শব্দ-সন্ত্রাস, যা এক পরিকল্পিত হিংসা, তারই নমুনা। যা বুঝিয়ে দেয়, আইনের আশ্রয়প্রার্থী নাগরিক আজ সহায়হীন। তার কেউ নেই, আছে কেবল অত্যাচারীর কাছে দীন আত্মসমর্পণ।
আইনরক্ষায় পুলিশ-প্রশাসনের এই ধারাবাহিক ব্যর্থতার সামনে দাঁড়িয়ে আইন নিয়েই প্রশ্ন তোলা দরকার। আইন দূষণকারী বাজির মোকাবিলা করতে চাইছে ‘সবুজ বাজি’ দিয়ে। কিন্তু সবুজ বাজি বস্তুত দূষণ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আইনের ফাঁক গলে দূষণের ছাড়পত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সাক্ষী দিল্লিও। সুপ্রিম কোর্ট সবুজ বাজি বিক্রির নির্দেশকে নস্যাৎ করে যথেচ্ছ বিষাক্ত বাজি ফেটেছে। রাজধানীতে ৩৮টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ৩১টিতেই বাতাসের মান ‘খুব খারাপ’ বলে ধরা পড়েছে, তিনটিতে ‘মারাত্মক’। স্বাস্থ্যের উপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কত গভীর ও ভয়ানক হবে, সে সম্পর্কে বাজি-ব্যবসায়ী ও তাঁদের রাজনৈতিক মদতদাতাদের মাথাব্যথা নেই। দূষণের মাত্রা নিয়ে যদি কিছুমাত্র শঙ্কিত হতেন তাঁরা, তা হলে বাজি নির্মাণের উৎসেই কড়া নিয়ন্ত্রণ করতেন। অনুমোদনহীন বাজি কারখানা বন্ধ হত, নিষিদ্ধ বাজির ব্যবসায়ীরা গ্রেফতার হতেন, গুদাম থেকে বাজি বাজেয়াপ্ত হত। সে সব কিছুই হয়নি, কেবল বাজির খুচরো বিক্রেতা ও ক্রেতার উপরে নজরদারি চলছে। প্লাস্টিক, অবৈধ মদ, দূষণকারী বাজি, যে বস্তুগুলি জনজীবন ও পরিবেশকে বিপর্যস্ত করছে, বিষাক্ত করছে, তার প্রতিটি চলছে রাজনীতি ও প্রশাসনের পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তায়। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদগুলি সদস্যদের বেতন দেওয়া ছাড়া আর কী করে, স্পষ্ট নয়।
এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে পরিবর্তন আনতে হবে নীতিতে। গত কয়েক বছরে স্পষ্ট হয়েছে যে বাজির মান নিয়ন্ত্রণ করতে অনাগ্রহী প্রায় সব রাজ্য। আইনরক্ষায় ব্যর্থতাই নিয়ম হয়ে উঠেছে। অতএব আইনসভায় আইন করে, অথবা আদালতের নির্দেশ প্রার্থনা করে, বন্ধ করতে হবে ‘সবুজ বাজি’-র ছিদ্র। সব ধরনের শব্দবাজির উৎপাদন, বিপণন এবং ক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে, বিধিভঙ্গ করলে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। দূষণ ও স্বাস্থ্যহানির সামনে বিনোদনের আকুতি, কিংবা ঐতিহ্য রক্ষার অছিলা গ্রহণযোগ্য নয়। উৎসব উদ্যাপনের নতুন নতুন রীতি আগেও তৈরি হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। অপরের পীড়নকে পরিহার করে আনন্দ করার পথ খুঁজতে হবে সমাজকে। আপাতত বাজির সম্পূর্ণ বর্জনকেই নীতি বলে গ্রহণ করতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)