কিছু কিছু অঙ্ক থাকে যা সহজ যোগবিয়োগে করা যায় না। ভারতীয় সংস্কৃতি সেই রকমই একটি যৌগিক ও জটিল অঙ্ক। সরল যোগবিয়োগ দিয়ে যাঁরাই সমাধান করার চেষ্টা করেছেন, বিবিধ অনিশ্চয়তা ও বিনষ্টির সূচনা ছাড়া বিশেষ কিছু করতে পারেননি। একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, উর্দু ভাষা। ভারতে হিন্দুত্ব রাজনীতি শিবির বেশ অনেক কালই এই ভাষাটিকে মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম করে দেখছে, ফলত এর আমূল বিনাশের প্রয়াস করে চলেছে। স্বভাবতই, বর্তমান নরেন্দ্র মোদী শাসিত ভারতে সেই প্রয়াস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশে দীর্ঘকাল প্রচলিত উর্দু ভাষা শিক্ষার ক্লাসগুলি একেবারে বন্ধ হওয়ার জোগাড়, সেই জায়গায় নতুন করে চালু হচ্ছে হিন্দি ভাষার ক্লাস। অর্থাৎ এই যে তথাকথিত হিন্দি-উর্দু দ্বৈরথ হিসাবে দেখা হচ্ছে ভাষাসমাজকে, তা আসলে আজকের ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিরোধচিন্তারই একটি প্রত্যক্ষ প্রতিফলন। এর পিছনে সরকারি প্রণোদনা ও সামাজিক কড়াকড়ি উভয়ই সক্রিয়। প্রশ্ন এখানে তিনটি। প্রথম, এ কথা কি ইতিহাসগত ভাবে যথার্থ যে উর্দু কেবল মুসলমান সমাজের ভাষা? দুই, যদি তর্কের খাতিরে সেটাই ধরে নেওয়া হয়— তা হলেও কি একটি ভাষাকে এই ভাবে বয়কট করা ও বিনাশ করা উচিত বা সম্ভব? এত দীর্ঘ কাল ধরে ভারতের মাটিতে যে উর্দু সংস্কৃতির প্রচলন থেকেছে, তার শিকড় উপড়ে ফেলার চিন্তা কি এক ভয়ঙ্কর সাংস্কৃতিক হিংসা নয়? তিন, যদি বা মুসলমানদেরই ভাষা হয় উর্দু, তা হলেও তো তাদের শিক্ষার কারণে অন্তত ভাষা শিক্ষাটি জারি থাকা উচিত। হিন্দির সঙ্গে উর্দুর সংযোগটি ঘনিষ্ঠ, তাদের কোনও আড়াআড়ি থাকার কথা নয়। হিন্দির সঙ্গে যদি অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা শেখা যায়— যে সব ভাষার সঙ্গে হিন্দির দূরত্ব অনেক বেশি, তা হলে হিন্দির সঙ্গে উর্দু ক্লাসও চালু রাখতে অসুবিধা কী? না কি এর মধ্যে একটা সামাজিক অস্পৃশ্যতার বোধ কাজ করছে? স্পষ্টতই, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে নিহিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অসহনশীলতার একটি তীব্র রূপ।
প্রথম প্রশ্নে ফেরার আগে বলা জরুরি, উর্দু ভাষার এই দুুর্দশা কেবল অসহিষ্ণু হিন্দুত্ববাদীদের কারণে নয়, অসহিষ্ণু ইসলামি মৌলবাদীরা এর জন্য সমান, কিংবা আরও বেশি দায়ী। গত এক শতকেরও বেশি সময় ধরে তাঁরা তৈরি করে চলেছেন এক ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক সমীকরণ, কট্টর (ভাষান্তরে ‘সাচ্চা’) মুসলমান মানেই উর্দুভাষী, উর্দুপ্রেমী হতে হবে, এবং উল্টোটা। ঠিক এই কারণেই, অসহিষ্ণু, পরমতবিদ্বেষী মুসলমান গোষ্ঠীর চাপে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের উর্দু অ্যাকাডেমি লিবারাল কবি-সঙ্গীতরচয়িতা জাভেদ আখতারের সফর বাতিল করল। কে তাঁদের এই অধিকার দিল— কে বা কারা তা স্থির করল, জাভেদ আখতারদের চেয়ে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীদের উর্দু অ্যাকাডেমির প্রতিনিধিত্বের অধিকার বেশি? অবশ্যই এর পিছনে রাজনৈতিক স্বার্থ ও সমর্থন ক্রিয়াশীল। তাই উগ্র হিন্দিভাষীদের সমর্থন জোগানোর জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকারও যেমন নিন্দার্হ, উগ্র উর্দুভাষী মৌলবাদীদের মাথায় তোলার জন্য রাজ্যে তৃণমূল সরকারের ভূমিকাও একই রকম অনৈতিক ও সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট। এই একটি পদক্ষেপের মধ্যে ছিল সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের যুক্তসমাজ-সংস্কৃতির অপমান, আগেই এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আলোচিত (‘এ রাজ্যের অসম্মান’, ৪-৯)।
ফেরা যাক একটি গোড়ার কথায়। উর্দু কার ভাষা? ইতিহাস বলে, এই ভাষা কেবল মুসলমানদের নয়, কেবল ভারতীয় মুসলমানদের নয়, বরং এই উপমহাদেশে একটি বিস্তীর্ণ জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসাবে উর্দুর সৃষ্টি হয়েছিল, অন্যান্য ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষও যার অংশী ছিলেন। অবশ্যই ইসলামি শাসন শুরু হওয়ার পরই এই ভাষার সূচনা হয়। প্রাথমিক ভাবে সেনা ছাউনিতে নানা ধর্মের, নানা অঞ্চলের মানুষ একত্র থাকতে থাকতে এই ‘ক্যাম্প ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা শিবিরভাষাটি উদ্ভূত হয় বলে কথিত। তাই উর্দু কাব্য সাহিত্য সঙ্গীতে হিন্দু অবদান বিস্তর। সে দিনের কৃষণ চন্দ্র, দেবেন্দ্র সত্যার্থী, রামানন্দ সাগর, কানহাইয়ালাল কপূর, আজকের গুলজ়ারদের বাদ দিয়ে সাদাত হাসান মান্টো, ইসমত চুগতাই, কারাতুলেন হায়দরদের ভাবা অসম্ভব। আবার আমির খসরু থেকে শুরু করে কাইফি আজ়মি, জাভেদ আখতাররা যে সমন্বয় সংস্কৃতির প্রতিনিধি, তাকে বাদ দিয়েও উর্দুর কোনও অ্যাকাডেমি বা চর্চা অসম্ভব। ভারতীয় সংস্কৃতির যোগবিয়োগের অঙ্কটি যে কোনও ধর্মের মৌলবাদীদের পক্ষেই কষা কঠিন। মৌল বলতে যা বোঝায়, ভারতীয় সংস্কৃতির যৌগ ডিএনএ-তে তা খুঁজে বার করা কেবল দুষ্কর নয়, অসম্ভব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)