E-Paper

গণতন্ত্রের বিপদ

গণতন্ত্রের অন্য দু’টি স্তম্ভের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ক্রমে তলানিতে এসে ঠেকেছে— বিচার বিভাগের প্রতি বিশ্বাসটিও নষ্ট হলে দেশ চলবে কিসের ভরসায়, উপরাষ্ট্রপতি সম্ভবত সে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবিত নন।

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৫ ০৬:২৭

ভারতের উপরাষ্ট্রপতির পদটি যে অরাজনৈতিক, বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসাবে পক্ষপাতহীন থাকা তাঁর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, জগদীপ ধনখড়কে সে কথা মনে করিয়ে দেওয়া অবান্তর। প্রশ্ন হল, তার পরও তিনি কেন বারে বারেই সুপ্রিম কোর্ট বিষয়ে এমন মন্তব্য করেন, যেগুলি তাঁর উচ্চ পদের সঙ্গে আদৌ মানানসই নয়? ভারতীয় গণতন্ত্র নিশ্চয়ই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে। তামিলনাড়ুর রাজ্যপালের সচেতন দীর্ঘসূত্রতা বিষয়ে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদটির এই প্রয়োগ যথাযথ কি না, সে প্রশ্নের উত্তর সন্ধান না করেও বলা যায় যে, মাননীয় উপরাষ্ট্রপতি এর প্রতিক্রিয়ায় যে ভাষায় সুপ্রিম কোর্টকে আক্রমণ করেছেন, তা ভয়ঙ্কর। বিরোধী দলগুলি স্বভাবতই তার প্রতিবাদ করেছে, কেউ কেউ ধনখড়ের পদত্যাগও দাবি করেছে। গত বছরও সংবিধানের ‘বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন’ বিষয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের অবস্থানকে যে ভঙ্গিতে সমালোচনা করেছিলেন, তাকেও ‘স্বাভাবিক’ বলে দাবি করা মুশকিল। উপরাষ্ট্রপতি পদে আসীন কোনও ব্যক্তি যদি দেশের শীর্ষ আদালত সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করতেই থাকেন, গণমানসে তার প্রভাব সাংঘাতিক হতে পারে। মানুষের মনে শীর্ষ আদালতের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। গণতন্ত্রের অন্য দু’টি স্তম্ভের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ক্রমে তলানিতে এসে ঠেকেছে— বিচার বিভাগের প্রতি বিশ্বাসটিও নষ্ট হলে দেশ চলবে কিসের ভরসায়, উপরাষ্ট্রপতি সম্ভবত সে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবিত নন।

তামিলনাড়ুর রাজ্যপালের বিল ফেলে রাখার প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালত ১৪২ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করায় ধনখড় তাকে বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের উদ্দেশে মিসাইল নিক্ষেপ’। কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। রাজ্যপাল নামক মূলত আলঙ্কারিক একটি পদের অধিকারীরা ভারতের অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকারের কাজে যে ভাবে বাধা সৃষ্টি করেই চলেছেন, উপরাষ্ট্রপতি কি তবে তাকেই ‘গণতন্ত্র’ বলে মনে করেন? অনুমান করা চলে যে, গণতন্ত্র বিষয়ে তাঁর তেমন শিরঃপীড়া নেই। বর্তমান পদে উপবিষ্ট হওয়ার আগে তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন, তখন তিনিও রাজ্য সরকারের প্রতিটি কাজে বাধা দেওয়ার কাজটি নিষ্ঠাভরে করেছেন— যেমন, সি ভি আনন্দ বোস এখন করছেন। গণতন্ত্রের জন্য ভাবনা থাকলে বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির এই পরিস্থিতি নিয়ে উপরাষ্ট্রপতি উদ্বিগ্ন হতেন। তেমন উদ্বেগের কোনও নিদর্শন আজ অবধি মেলেনি। ফলে, অনুমান করা যেতে পারে যে, কোনও ক্রমেই যাতে বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সেটুকু নিশ্চিত করার মধ্যেই তাঁর উদ্বেগ সীমাবদ্ধ।

তাঁর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজে যে আলোচনা হয়েছে, তাতে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কথা এসেছে— কী ভাবে তিনি জনতা দল থেকে কংগ্রেস হয়ে শেষ অবধি বিজেপিতে পৌঁছেছিলেন, সে চর্চা হয়েছে। কিন্তু, তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে আলোচনা অপ্রয়োজনীয়। পরিহার্যও বটে। কেউ সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন যে, রাজ্যপাল হিসাবে ধনখড় যা করে এসেছেন, এবং উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে যা করছেন, তার কোনওটাই তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত নয়। প্রকাশভঙ্গি তাঁর নিজস্ব হতে পারে, কিন্তু তাঁকে ব্যবহার করা হচ্ছে এক ‘ডিসরাপ্টিভ ফোর্স’ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী শক্তি হিসাবে। গণতন্ত্রের প্রকৃত চলনপথে যে ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে শেষ পর্যন্ত বিজেপির লাভ, সেই গোত্রের অশান্তি তিনি সহজে পাকাতে পারেন— গৈরিক রাজনীতির কাছে এটাই তাঁর গুরুত্ব। নিন্দকের এই সন্দেহটি যদি সত্য হয়, তবে তা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এক অতি দুঃসংবাদ— সংবিধানের অন্যতম শীর্ষ পদের অধিকারী গণতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করছেন, এমন বার্তা ভারতের সম্মানের পক্ষেও মারাত্মক। উপরাষ্ট্রপতি তাঁর পদের গুরুত্ব বুঝে আচরণে সংযত হবেন, এটুকু আশাও কি ভারত করতে পারে না?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Jagdeep Dhankhar Vice President Supreme Court of India

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy