ফাইল চিত্র।
নরেন্দ্র মোদী এক কালে ঘন ঘন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করিতেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন তাঁহার সম্মুখে ছিল। আজ আর তাঁহার গুরুবরকে প্রয়োজন নাই। তাহাতে হয়তো তিনি হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছেন,
কারণ রবীন্দ্রনাথের কথাবার্তা প্রায়শই তাঁহার পক্ষে অত্যন্ত অস্বস্তিকর। রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান’। এক ধরনের গণতান্ত্রিকতার আদর্শ এই বাণীতে নিহিত আছে, যে আদর্শ মানিলে রাজার রাজত্বে সবাই রাজা হইতে পারেন। বস্তুত, কেবল রাজধর্মের উচ্চালোকে নহে সমাজজীবনের দৈনন্দিন পরিসরেও শিশুশিক্ষার প্রথম পাঠে বলা হয়: অন্যের সম্মান করিলে অন্যেও তোমার সম্মান করিবে, তাহাই প্রকৃত সম্মান। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীদের রাজধর্ম এবং শৈশব-শিক্ষা, কোনওটিতেই বোধ করি এমন নীতির কথা কস্মিন্কালে লেখা বা বলা হয় না। সেই পাঠ্যসূচির প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় আদি সমস্ত ভাগেই ক্রমাগত একটি শিক্ষাই পাখি-পড়ানো হয়— অপরকে ছোট করিয়া, অগ্রাহ্য করিয়া কেবল নিজের এবং নিজেদের ঢাক প্রচণ্ড রবে পিটাইতে হয়, এই শিক্ষা। আত্মপ্রচারের বহর যত বিপুল হইবে, অন্যের গৌরবকে অস্বীকার করিবার প্রবণতাও ততটাই প্রবল হইবে— ইহাই তাঁহাদের জীবনাদর্শ।
ইহারই আর এক উৎকট নিদর্শন দেখা গেল, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের বিভিন্ন মঞ্চে কেন্দ্রীয় সরকার তথা শাসক দলের উচ্চারণে ইন্দিরা গাঁধী কার্যত অনুপস্থিত থাকিয়া গেলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভারতের ভূমিকা এবং সেই ভূমিকার রূপকার হিসাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর গুরুত্ব অস্বীকার করিবার কোনও প্রশ্নই নাই, এই বিষয়ে তাঁহার অতি বড় সমালোচকও সম্পূর্ণ একমত হইবেন। সেই গুরুত্বের প্রমাণ হিসাবে অটলবিহারী বাজপেয়ীর শংসাপত্রের উল্লেখেরও কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, তাহা গোটা দুনিয়ার সুবিদিত। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার সহনায়কদের কর্তব্য ছিল সেই সত্যকে উচ্চকণ্ঠে স্বীকার করা, ইন্দিরা গাঁধীকে এই বিষয়ে তাঁহার প্রাপ্য ঐতিহাসিক সম্মান জ্ঞাপন করা। তাহাতে ভারতীয় রাষ্ট্রের সম্মান বাড়িত, সেই রাষ্ট্রের বর্তমান চালক হিসাবে তাঁহারা নিজেরাও সম্মানিত হইতেন। কিন্তু ঘটিল তাহার বিপরীত। এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণে এমন অ-স্বীকৃতি তাঁহাদের মানসিক ক্ষুদ্রতাকেই প্রমাণ করিল, অসম্মানিত করিল ভারতকেও।
ইহা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে। বর্তমান শাসকরা ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ ভারতের রাজনৈতিক স্লোগানটিকে এমন আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগে তৎপর যে, দেশের ইতিহাস হইতেও কংগ্রেসের সমস্ত চিহ্ন মুছিয়া দিতে পারিলেই যেন তাঁহাদের অন্তরাত্মা তৃপ্ত হয়। জওহরলাল নেহরু সম্পর্কে তাঁহাদের বিরাগ ইতিমধ্যে অতিমাত্রায় প্রকট, প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তারস্বরে প্রচার করেন যে, নেহরু তথা কংগ্রেসের শাসনে ভারতের কোনও উন্নতিই হয় নাই। কংগ্রেস শাসনের, বিশেষত ইন্দিরা গাঁধীর জমানার সম্পর্কে বিস্তর সমালোচনার কারণ আছে, কিন্তু তাঁহাদের নামগন্ধ মুছিয়া দিবার এই চেষ্টা সমালোচনা নহে, ইহা সত্যকে মিথ্যা করিবার দুর্বুদ্ধি, যাহা জর্জ অরওয়েল-এর উপন্যাস মনে পড়াইয়া দেয়। বস্তুত, পারিলে এই শাসকরা বুঝি গাঁধীজির নামও মুছিয়া ফেলিতেন, তাহা নিতান্ত অসম্ভব বলিয়া তাঁহাকে আত্মসাৎ করিবার বিচিত্র কসরত চালাইয়া থাকেন। এই আচরণের কারণ সম্ভবত সহজবোধ্য। যাঁহারা অন্তরে নিজেদের মর্যাদা লইয়া সতত গভীর অনিশ্চয়তায় ভুগিয়া থাকেন, তাঁহারাই প্রাণপণে অন্যদের সমস্ত কৃতি ও অবদানকে অস্বীকার করিতে ব্যস্ত হন। তাঁহারা জানেন, লোকে তাঁহাদের সম্মান করে না, বড়জোর ভয় পায়, অতএব জোর করিয়া সমস্ত বিষয়ে সব কৃতিত্বের স্বীকৃতি বেদখল করিবার এমন মরিয়া উদ্যোগ। এই ব্যাধি সারিবার নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy