Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

ছুটতে ছুটতে হঠাৎ বেলাইন

চের্নোবিলে অনেক দমকল কর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্রাথমিক অবস্থায় কোনও সুরক্ষা ছাড়াই আগুন নেভাতে তাঁরা তৎপর হয়েছিলেন।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শৌনক দত্ত
শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০২০ ০১:০৬
Share: Save:

আমরা ছুটছিলাম। অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো। ঘৃণা নিয়ে, বিদ্বেষ নিয়ে, উপরে ওঠার প্রবল তাড়া নিয়ে। আমরা ঠুলি-আঁটা চোখে ভীষণ গতিতে এগিয়ে যাওয়ায় মগ্ন থেকেছি। প্রত্যেকে নিজের নিজের কোটরে গলা ডুবিয়ে ছিলাম, যাতে আত্মবিশ্লেষণের জন্য এক চিলতে জায়গাও ফাঁকা না থাকে। করোনাভাইরাস সে দুর্গতিকে রুদ্ধ করল। আমরা কি জানতাম এমন কিছু হতে পারে? না। কিন্তু এটুকু জানতাম যে কোনও তীব্র সঙ্কট যখন-তখন তার আগ্রাসন দিয়ে আমাদের গতিকে থামিয়ে দিতে পারে। তাই তো আমাদের এত তাড়া ছিল। কেবল সঙ্কট যে এমন বিশ্বব্যাপী হবে, এমন চিন্তা মনে আসেনি। সকলে ভেবেছি, যা-ই হোক আমার কিছু হতে দেওয়া যাবে না। আমার মগ্নচৈতন্য যেন বিঘ্নিত না হয়। এই ভাবনার মধ্যে সম্মিলিত থাকার যাবতীয় উপাদান থাকা সত্ত্বেও স্বার্থের আরোপিত নেশা সে উপাদানকে কাজে লাগাতে দেয়নি। অবসরকে কাজে লাগিয়ে জীবনবোধকে হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষমতা হারাতে হারাতে আমরা আজ আবার মৃত্যুপথযাত্রী। আমরা আজ আবার সংখ্যা হয়েছি।

বেলারুসের নোবেলজয়ী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক স্বেতলানা আলেক্সিয়েভিচ ১৯৮৬ সালে চের্নোবিলের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের অব্যবহিত পর থেকে বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নেন, এবং তার উপর ভিত্তি করে একটি বই লেখেন— চের্নোবিল প্রেয়ার/ ভয়েসেস ফ্রম চের্নোবিল (১৯৯৭)। সেই বইয়ের প্রত্যেক পাতায় ধরা আছে মানুষের স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার মর্মস্পর্শী আলেখ্য। সন্তানহারা এক পিতা সাক্ষাৎকারে বলছেন, “দশ বছর আগের ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা আমার পরবর্তী জীবনের প্রত্যেক দিনের ভূমিকা বেঁধে দিয়ে গিয়েছে। আমার আর মনে পড়ে না, ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬-র আগে আমার জীবনে কোনও আনন্দঘন মুহূর্ত এসেছিল কি না। শুধু মনে পড়ে, আমার একটা অত্যন্ত সাধারণ জীবন ছিল। অসাধারণ কিছু ঘটার কথা কল্পনাতেও আসেনি। প্রথম দিন মধ্যরাতে আমরা দূর থেকে বিস্ফোরণের আগুন দেখছিলাম একসঙ্গে। আমাদের প্রিপিয়াত-এর আকাশ সেই রাতে ঝলসে উঠেছিল। পরের দিন থেকে একটা গন্ধ নাকে লেগে থাকল। সেই ঝলসানো আকাশ আর অদ্ভুত পোড়া গন্ধটাই জীবনে প্রথম অসাধারণকে আমার কাছে এনে দিল। ওই দৃশ্য আর গন্ধ দশ বছরে এক দিনও আমাকে ছেড়ে যায়নি।”

বিশ্বজোড়া ত্রস্ত আবহে করোনাও কত সাধারণ জীবনকে ‘অসাধারণ’ করে দিয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই করেছে। একবিংশ শতকের মানুষের মুঠোয় থাকা বিশ্বে রোজ মৃত মানুষের সংখ্যা গুনছি আমরা। আপ্রাণ চেষ্টা চলছে— অনেক বেঁচে থাকা মানুষ সাধ্যমতো বা সাধ্যের বাইরে গিয়ে এক অসম লড়াই লড়ে যাচ্ছেন। কয়েক প্রজন্ম পরে এই চরম বর্তমান আবেগমথিত অতীতের জায়গা নেবে। ইতিহাস বলবে, এত আক্রান্ত সংখ্যা, এত মানুষ সুস্থ হয়েছিলেন, আর এত জন মারা গিয়েছিলেন। এখন যে ভাবে ইতিহাস পড়ি সাল-সংখ্যায় জড়িয়ে— একক মানুষের অজস্র গাথা হারিয়ে যায় কোন সমুদ্রে। সে সমুদ্র মন্থন করার আয়োজন দেবকুল আর করবেন কি না জানা নেই। তবে এটুকু জানি যে মারণ ভাইরাস এক সঙ্গে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের পাতায় এ ভাবেই অক্ষয় হয়ে থাকবে।

চের্নোবিলে অনেক দমকল কর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্রাথমিক অবস্থায় কোনও সুরক্ষা ছাড়াই আগুন নেভাতে তাঁরা তৎপর হয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন না, উন্মুক্ত শরীরে মারাত্মক বিষক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। কেউ এক দিনের মধ্যে ঘটনাস্থলেই মারা যান। কয়েক জনকে চিকিৎসার জন্য মস্কো নিয়ে যাওয়া হয়। এক দমকল কর্মীর স্ত্রী বলছেন, “কিসের কথা বলব? মৃত্যুর কথা, না কি আমার ভালবাসার কথা? আজ তো আমার কাছে দুই-ই সমান। ভালবাসাকে আমি মৃত্যুর স্মৃতি দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি।” তাঁর স্বামী মস্কোর হাসপাতালে অস্থিসার দেহে যে ক’দিন বেঁচে ছিলেন, ল্যুদমিলা উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটে যেতেন তাঁর বিছানার পাশে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে তাঁকে বার বার সতর্ক করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, রেডিয়েশনের সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করে ঠিক করছেন না তিনি। তাঁকে থামানো যায়নি। দলা পাকানো মৃতদেহ কফিনবন্দি করে কফিনটি দস্তা দিয়ে ঝালাই করে দেওয়া হচ্ছে দেখে ল্যুদমিলা কেঁদে উঠেছিলেন।

জীবনটা ঠিকঠাক চলার সময় আমরা একটু দূর অবধি ভেবে নিয়ে নিজেকে বলি, আমার মৃত্যুও হবে সর্বাঙ্গসুন্দর। কিন্তু হয় না। আমরা একটিমাত্র মৃত্যুর শোকে বিহ্বল হতে হতে হঠাৎ দেখি চার পাশে বিপুল মৃত্যুমিছিল। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া দেহে সে মানুষ মৃত্যুযাত্রায় হয়তো প্রথম বার আরাম পায়।

অধুনা মানুষের আত্মমগ্ন থাকার রাস্তায় করোনা এক বিপুল অন্তরায়ের নাম। স্তব্ধতা আর বিষণ্ণতার এই আচমকা আঘাত থেকে আমরা সবাই মুক্তি পাব না। আমাদের মধ্যেই কেউ কালকের ধ্রুবতারা আর দেখতে পাবে না। আমার আশপাশের কেউ হয়তো ভোর রাতে আর উঠবে না ফুল চুরি করতে। তবু যাঁরা বেঁচে থাকবেন, যাঁরা পূর্ণিমার চাঁদ আরও অনেক বার দেখবেন, ফুল চুরি ছেড়ে একটি ফুলগাছ বসাবেন, সেই মৃত্যুঞ্জয়ীরা ভবিষ্যৎকে একটি বার অন্তত বলে যাবেন, চরম গতিতে এগিয়ে যাও, ক্ষতি নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে থামতে হবে, গতি যখন তখন রুদ্ধ হবে; তার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত রেখো।

তুলনামূলক সাহিত্যের গবেষক, বিশ্বভারতী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Chernobyl Disaster
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE