Advertisement
E-Paper

তাঁর বাঁশি বাজান চৌরাসিয়াও

নেশা বলতে বাঁশিই। পেশায় অবশ্য শিক্ষক। বাঁশি তৈরির প্রশিক্ষণ কখনও নেননি। তবে আজ তাঁর তৈরি বাঁশি বাজান হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াও। কীভাবে শুরু পথ চলা? জনপ্রিয়তাই বা কেমন? এমনই কিছু প্রশ্ন করেছিলেন অনিতা দত্ত। উত্তর দিলেন দেবকুমার সিংহ। নেশা বলতে বাঁশিই। পেশায় অবশ্য শিক্ষক। বাঁশি তৈরির প্রশিক্ষণ কখনও নেননি। তবে আজ তাঁর তৈরি বাঁশি বাজান হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াও। কীভাবে শুরু পথ চলা? জনপ্রিয়তাই বা কেমন? এমনই কিছু প্রশ্ন করেছিলেন অনিতা দত্ত। উত্তর দিলেন দেবকুমার সিংহ।

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৪১
একই সঙ্গে স্রষ্টা ও সৃষ্টি। নিজস্ব চিত্র

একই সঙ্গে স্রষ্টা ও সৃষ্টি। নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: কবে থেকে বাঁশি বানাচ্ছেন?

উত্তর: ছোটবেলা থেকেই, তা প্রায় পাঁচ- ছ’ বছর বয়স থেকে। তখন থেকেই এটা আমার প্যাশন বা হবি যাই বলুন।

প্রশ্ন: ওটা যদি প্যাশন হয় তবে আপনার পেশা কী?

উত্তর: আমি বর্তমানে মালদহ কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াই। আগে ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত শিলিগুড়ি বাণীমন্দির স্কুলে পড়িয়েছি। তারও আগে ব্যাঙডুবি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। শিলিগুড়ি কলেজেও আংশিক সময়ের শিক্ষক ছিলাম।

প্রশ্ন: পরিবারে বাঁশি বানানোর চল ছিল?

উত্তর: বানানোর নয়, বাজানোর চর্চা ছিল। দাদা বাজাতেন। জন্মের পর থেকেই দাদার বাঁশির সুর আমাকে আকৃষ্ট করত। মোহিত হয়ে শুনতাম। দাদার বাঁশিই লুকিয়ে চুরিয়ে বাজাতাম। বাবা বেহালা বাজাতেন। পিসতুতো দাদা যাত্রা দলে বাঁশি বাজাতেন। বলতে পারেন, বাড়িতে সুরের চলাচল ছিল।

প্রশ্ন: বাঁশি বানাতে শুরু করলেন কবে থেকে?

উত্তর: বাঁশির প্রতি, সুরের প্রতি আগ্রহ আমার জন্ম থেকে। ভাল বাঁশি পেতাম না বলে নিজেই খুঁজে খুঁজে বাঁশ জোগাড় করে বাঁশি বানাতাম।

প্রশ্ন: এখনও পর্যন্ত কতগুলি বাঁশি বানিয়েছেন, কী কী ধরনের বাঁশি?

উত্তর: প্রায় দশ হাজার বাঁশি তৈরি করেছি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দু’টো ভাগ রয়েছে। কর্নাটকি এবং হিন্দুস্থানি বা উত্তর ভারতীয়। আমি যে বাঁশিটা বানাই তা হিন্দুস্থানি বা ক্ল্যাসিকাল ফ্লুট। এটায় বহুস্তরের সুর বাঁধা হয়। সর্বশেষ স্তর ডিজিটাল টিউনেশন।

প্রশ্ন: কোন বাঁশ থেকে তৈরি হয়, পদ্ধতিটা কী?

উত্তর: বাঁশটার নাম ঠিক জানি না। এ বাঁশ জন্মায় শিলচর থেকে প্রায় ৪৫- ৫০ কিলোমিটার দূরের গভীর জঙ্গলে। ত্রিপুরাতেও পাওয়া যায়। সেখান থেকেই সংগ্রহ করি। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকেও কিছু বাঁশ অর্ডার করেছি। ছোট থেকেই যখন বানাতাম তখন সাবেকি পদ্ধতিতেই বানাতাম। পরবর্তী কালে বিজ্ঞানের প্রয়োগ করি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শব্দবিজ্ঞানের সাহায্যে এই বাঁশি তৈরি করছি। যে শব্দবিজ্ঞানে রয়েছে হার্জ, পিচ, ফ্রিকোয়েন্সি।

প্রশ্ন: বাঁশি তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন?

উত্তর: না, সুযোগ হয়নি।

প্রশ্ন: আপনার বাঁশির ক্রেতা কারা?

উত্তর: যেহেতু এর সঙ্গে আমার রুটিরুজির যোগ নেই, এটা আমার পেশা নয়, সেহেতু আজও প্রচারের কোনও চেষ্টা করিনি। তবে এখনও পর্যন্ত বহুদেশে আমার তৈরি বাঁশি গিয়েছে। বহু বিখ্যাত, স্বনামখ্যাত বাঁশিবাদক আমার বাঁশি বাজান।

প্রশ্ন: যেমন? কয়েক জনের নাম?

উত্তর: কানাডার সাহিন মাহামুদুর। পাকিস্তানের উস্তাদ সালমান আদিল, ফারাজ আহমেদ, দুবাইতে মহম্মদ আলি কুটুমুন্ডু, ঢাকায় ইমতিয়াজ খান, মিঠুন বৈরাগী, কলকাতায় সুব্রত গগৈ, তন্ময় মণ্ডল, পঞ্জাবে হরবিন্দর সিংহ, দিল্লির সুবীর ঠাকুর কত জনের কথা বলব! এরা আমার বানানো বাঁশি পছন্দ করেন বাজাতে। এ ছাড়া অসম, হরিয়ানা, গুজরাতেও আমার প্রচুর বাঁশি গিয়েছে। গত বছর মহাসপ্তমীতে মুম্বইয়ে গুরুকুলের অনুষ্ঠানে হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া যে বাঁশিটি বাজিয়েছিলেন, তা আমারই তৈরি।

প্রশ্ন: এত বিখ্যাত শিল্পী আপনার তৈরি বাঁশি বাজান। কেমন অনুভূতি হয়? তাঁরা কী বলেন আপনার বাঁশির বিষয়ে?

উত্তর: কী অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। হরিপ্রসাদজী প্রভূত প্রশংসা করেছেন।

প্রশ্ন: শিক্ষকতার পাশাপাশি বাঁশি বানানোর সময় পান কখন?

উত্তর: কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে ছাত্রছাত্রীদের পড়াই। রাতে বাঁশি বানাতে বসি। প্রায়শই রাত ভোর হয়ে যায়।

প্রশ্ন: কত দিন হল বানাচ্ছেন? বানানোর প্রশিক্ষণ দেন?

উত্তর: আমার বয়স ৪৮। তা প্রায় ৪২ বছর ধরে বানাচ্ছি। আর প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো আগ্রহী কাউকে পাইনি। এই ভেবে দুঃখ হয়, যে অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করেছি, আমি যখন থাকব না, এর উত্তরাধিকার বা ধরে রাখার কেউ থাকবে না। এটাই খুব ভাবায় আমায়।

প্রশ্ন: একটি বাঁশি বানাতে কতদিন সময় লাগে?

উত্তর: এক কথায় বলা মুশকিল। বাঁশ কাটার পর ন্যূনতম পাঁচ থেকে ছ’বছর লাগে সেই বাঁশটিকে বাঁশি বানানোর উপযোগী করে তুলতে। তারপর সারা দিন কাজ করতে পারলে তিন-চারটি বাঁশি বানানো যায়।

প্রশ্ন: আপনি নিজেও তো বাঁশিবাদক, কোথাও শিখেছেন? অনুষ্ঠান করেন?

উত্তর: না, শিখিনি কারও কাছে। সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে শুনে, দেখে দেখে শিখেছি। বাঁশিবাদক হিসেবে মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকেই ডাক পাই। শুধু বানানো বা বাজানোই নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন সেমিনারে বাঁশি সম্পর্কিত বক্তব্য রাখার জন্যও আমন্ত্রণ পাই, অংশ নিই। এই ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাঁশি নিয়ে বক্তৃতার আমন্ত্রণ এসেছে কলকাতার একটি কলেজ থেকে।

প্রশ্ন: দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে আপনার বাঁশি। উত্তরবঙ্গে বসে যোগাযোগ হয় কী করে?

উত্তর: এক জনের হাতে আমার বাঁশি পৌঁছলে অন্য জন সেই বাঁশি কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁরা খোঁজখবর নিয়ে যোগাযোগ করে নেন।

প্রশ্ন: দাম কী রকম পড়ে?

উত্তর: যেহেতু বাঁশগুলি বাইরে থেকে আনতে হয়, বিভিন্ন জনের মাধ্যমে বহু হাত ঘুরে আসে, তাই দাম একটু বেশিই রাখতে হয়। প্রায় ৩৬ রকমের বাঁশি হতে পারে। আমি বানাই ২৬ রকমের বাঁশি, যা বাজানো সম্ভব। কারণ এক একটি স্কেলে তিনটি অক্টেভ থাকে। ১২টি স্কেলের তিনটি অক্টেভ মানে ৩৬ রকমের হয় কিন্তু বাজানো যায় ২৬ রকমের বাঁশি। তারসপ্তকের বাঁশির কিছু কিছু স্কেলের আকার এতই ছোট হয় যে আঙুল ব্যবহার সম্ভব নয়।

প্রশ্ন: আপনি নিজে কী বাজাতে ভালোবাসেন?

উত্তর: শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ভিত্তিক সুর। সেটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়।

প্রশ্ন: বাঁশি নিয়ে কোনও স্বপ্ন দেখেন?

উত্তর: বাঁশি আমার পরম বন্ধু। সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী হল বাঁশির সুর। বাঁশির ইতিহাস তার সাক্ষী। যারা বাঁশিবাদক, বাঁশি প্রেমিক তাদের হাতে ঠিক সুরের বাঁশিটি পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখি আজও।

প্রশ্ন: বাঁশি নিয়ে কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?

উত্তর: অবসরের পরে সারাদিন বাঁশি বানাব। প্রশিক্ষণ দেওয়ারও ইচ্ছে আছে। (একটু থেমে) তা না হলে, ‘‘তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে?’’

Flute Hariprasad Chaurasia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy