Advertisement
E-Paper

একসঙ্গে আছি, একসঙ্গে থাকব

অস্ত্রটি তৈরিই ছিল, এ বার দিনক্ষণ দেখে ঝোপ বুঝে কোপ। প্রথম দফায় কোপে পড়েছেন চল্লিশ লক্ষ মানুষ। তাঁদের নাম ধাম গোত্র বংশলতিকা ইত্যাদি নিয়ে যত বিতণ্ডাই থাকুক, একটা ব্যাপারে তর্ক নেই। তাঁরা সবাই মানুষ। এই গোড়ার কথাটি প্রথমেই পরিষ্কার বুঝে নেওয়া খুব দরকার, কারণ সেটিকে গুলিয়ে দেওয়ার তুমুল চেষ্টা চলছে।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০

বেশ কিছু দিন ধরেই মনটা কুডাক ডাকছিল। ভোটের হাওয়া কোন বিষ-দরিয়ায় আবার তুফান তুলবে, ক’টা ঘরে আগুন লাগাবে, পুড়িয়ে মারবে ক’হাজার, সুখেদুঃখে মিলনে-বিচ্ছেদে শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বাস করা কত প্রতিবেশীকে আবার দু’ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে, সেই ভাগ হয়ে যাওয়া মানবসমুদ্রের মাঝখান দিয়ে আরও এক বার মসনদের দিকে হেঁটে যাবেন ক্ষমতার কারবারিরা? দাঙ্গা শুরু হবে কি আবার? অসহায় মানুষকে তার ঘরবাড়ি রুজিরোজগার স্বজনবান্ধব সমেত গ্রাস করবে সেই পরিকল্পিত ও সংগঠিত হিংসা— ঘৃণা ও বিদ্বেষের নিরন্তর ডোপিংয়ে যার দানবীয় মূর্তি উত্তরোত্তর দানবীয়তর? কী হবে সেই হিংসার তেজস্ক্রিয় জ্বালানি? অযোধ্যা? পাকিস্তান? না কি, এখন গরুই যথেষ্ট?

এই সব ভাবতে ভাবতেই সহসা উন্মোচিত হল জাতীয় নাগরিক পঞ্জি। অস্ত্রটি তৈরিই ছিল, এ বার দিনক্ষণ দেখে ঝোপ বুঝে কোপ। প্রথম দফায় কোপে পড়েছেন চল্লিশ লক্ষ মানুষ। তাঁদের নাম ধাম গোত্র বংশলতিকা ইত্যাদি নিয়ে যত বিতণ্ডাই থাকুক, একটা ব্যাপারে তর্ক নেই। তাঁরা সবাই মানুষ। এই গোড়ার কথাটি প্রথমেই পরিষ্কার বুঝে নেওয়া খুব দরকার, কারণ সেটিকে গুলিয়ে দেওয়ার তুমুল চেষ্টা চলছে। ১৯৬৬, ১৯৭১, অসম চুক্তি, বেআইনি অভিবাসী নির্ধারণ আইন, সুপ্রিম কোর্ট, শরণার্থী বনাম অনুপ্রবেশকারী— অনন্ত জটিলতার প্রতিটি জটই সত্য, কিন্তু সবার উপরে মানুষ সত্য।

ভরসার কথা, অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও সবাইকে সেটা ভুলিয়ে দেওয়া যায়নি। তাঁদের অন্তর থেকে উঠে আসছে অমোঘ প্রশ্নটি। যেমন সম্প্রতি এই সংবাদপত্রে লিখেছেন সুনন্দা শিকদার (‘এই কাজে আরও শক্ত হবে মৌলবাদীদের হাত’, ৩-৮): ‘‘এই ৪০ লক্ষ মানুষ হঠাৎ নাগরিকত্ব হারালে যাবেন কোথায়?’’ কার কোন সার্টিফিকেট আছে বা নেই, কে আইনি, কে বেআইনি, কে কবে কেন কী ভাবে এ দেশে এসেছিলেন— সে সব অঙ্ক কষে এই আদি প্রশ্নের তল পাওয়া যাবে না। সত্যি বলতে কী, আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা ব্যাপারটা বুঝতেই পারতেন না, বলতেন, ‘‘যে যে ভাবেই আসুক, এসে পড়েছে, এত দিন বাস করছে, খেয়েপরে বাঁচার চেষ্টা করছে, প্রাণপাত করে ছেলেপুলেগুলোকে মানুষ করছে, আজ হঠাৎ তাড়িয়ে দেব! নতুন করে লোকের আসা ঠেকাতে চাও ঠেকাও, তাই বলে ঘরের মানুষকে ঘরছাড়া করা যায় না কি, ও আবার কোন দেশি অসভ্যতা?’’ আসলে যাকে ভারী গলায় মানবিকতা ইত্যাদি নামে ডাকি, সেটা তো নেহাতই কাণ্ডজ্ঞান! একসঙ্গে বেঁচে থাকার কাণ্ডজ্ঞান।

এবং সেই কাণ্ডজ্ঞানই বিভাজনের রাজনীতির এক নম্বর নিশানা। ওই সহজ মানবিকতাকে প্রথমেই ধ্বংস করা চাই। আর তার জন্যে চাই মানুষকে ক্রমাগত ভাগ করার, এককে অন্যের থেকে দূরে ঠেলার, শত্রু বানানোর একাগ্র সাধনা। বিভাজনের কৌশলগুলো অনেক বুদ্ধি করে বানাতে হয়। এই যেমন, প্রথমে একটা চল্লিশ লক্ষ সংখ্যা চোখের সামনে ফেলে দিয়ে তার পর আশ্বাস: এ তো আর শেষ অঙ্ক নয়, ভয়ের কী আছে? কিন্তু যাঁদের শেষ অঙ্কও মিলবে না তাঁদের কী হবে? আরে না না, হিন্দুদের কোনও ভয় নেই! শুনে নাম-না-থাকা হিন্দুরা শান্তি পাবেন, হিন্দু সংহতি তাগড়াই হবে। কিন্তু নাম-না-থাকা মুসলমানদের কী হবে? কী আবার হবে? ভারত তো আর একটা ধর্মশালা নয়। (ঠিকই, ভারতকে যথার্থ অধর্মশালা বানানোই তো দরকার!) এরই মধ্যে ক্ষমতাবানরা নাকি কানে কানে ভরসা দিচ্ছেন: সত্যিই কাউকে দেশ থেকে বার করে দেওয়া হবে না, হয়তো কিছু লোককে ক্যাম্প করে রেখে দেওয়া হবে, বাকিরা ভয়ে ভয়ে থাকবে। এটাই আসল প্রকল্প। ভয় সৃষ্টির প্রকল্প। সংখ্যালঘুর ভয়ের উপরেই সংখ্যাগুরুর ক্ষমতার প্রাসাদ মজবুত হয়।

এই দানবের সঙ্গে লড়াইয়ে ইতিহাসের তথ্য, জনবিন্যাসের সংখ্যা, ভোটের বোঝাপড়া, জোটের পাটিগণিত— সব অস্ত্রই চাই। কিন্তু সর্বাগ্রে বুঝে নিতে হবে ওই গোড়ার কথাটি। কাণ্ডজ্ঞানের কথা। মানবিকতারও। যে মানবিকতা দাবি করে: আগে বলো, তুমি মানুষকে মানুষ ভাবো কি না। যে কাণ্ডজ্ঞান বলে: তুমি মানুষের সর্বনাশ করতে হিন্দু গুনবে, মুসলমান গুনবে— চলবে না। ক্ষমতার পথ বানাতে মানবসমুদ্রকে দু’ভাগ করা— চলবে না।

আবেগ? রোমান্টিকতা? আলবাত। নিঃসংশয় রোমান্টিকতা এবং মানুষী আবেগই এখন জরুরি। বস্তুত, অপরিহার্য। এই সত্য যদি এখনও না মানি, তা হলে এই দেশটা— না, দেশটা থাকবে, কিন্তু তার থাকা-না-থাকায় মানবসভ্যতার বিশেষ কিছু যাবে-আসবে না।

NRC Assam Draft
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy