Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

চিন-পালানো পুঁজি ধরতে নামছে ভারত, জমিও তৈরি, কিন্তু পারবে তো?

কোভিড উত্তর পর্বে বিশ্ব বাজারের চিত্রটা বদলাবেই। ঠিক কতটা তা বলা মুশকিল

অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২০ ১৮:২৬
Share: Save:

করোনা আতঙ্কে এই একটি খবর অন্তত বরাভয়ের। ভারত উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ টানার নাকি তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। লকডাউন পর্ব মিটলেই এ ব্যাপারে জোর কদমে লেগে পড়বে কেন্দ্রীয় সরকার। আর তার জন্য ভূমি তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে বলে বলা হচ্ছে।

এটা অবিশ্বাস করারও কোনও জায়গা নেই। কোভিড উত্তর পর্বে বিশ্ব বাজারের চিত্রটা বদলাবেই। ঠিক কতটা তা বলা মুশকিল। কিন্তু উৎপাদনের জন্য চিনের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যে ব্যগ্র থাকবে তা নিয়ে কিন্তু কোনও সংশয় নেই। সংশয় যেটুকু আছে তা হল, ঠিক কতটা কায়দা করে এই রাষ্ট্রগুলো চিন-নির্ভরতা কমিয়ে উঠতে পারবে তা নিয়ে। তার কারণ, এই মুহূর্তে চিন যে ভাবে বিশ্ব আর্থিক বাজারের উপর দখল নিয়ে নিয়েছে, একই সঙ্গে লতায় পাতায় বিশ্বের খনিজ সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে, তাতে ‘চিনকে খেলায় নেব না’ বলে বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রগুলির পক্ষে মুখ ফিরিয়ে থাকাটা কতটা সম্ভব তা নিয়ে একটা প্রশ্নচিহ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রতিটি আলোচনাতেই।

আগামীতে সব সংস্থাই চাইবে তাদের বিনিয়োগ বিশ্বে এমন ভাবে ছড়িয়ে দিতে, যাতে বিশেষ একটি দেশ আর ছড়ি ঘোরাতে না-পারে। আর সেই বিনিয়োগ ধরতে বিশেষ করে ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতও মাঠে নামবেই। মনে রাখতে হবে বিশ্বে উৎপাদন মানচিত্রে ভারতের স্থান ষষ্ঠ। চিন রয়েছে শীর্ষে ২৮.৪ শতাংশ ভাগ নিয়ে। আর তার পরেই ১৬.৬ শতাংশ ভাগ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সিঁড়িতে পর পর রয়েছে জাপান (৭.২ শতাংশ), জার্মানি (৫.৮ শতাংশ), দক্ষিণ কোরিয়া (৩.৩ শতাংশ) আর তার পরেই ভারত (৩ শতাংশ)। এ তথ্য রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান বিভাগের, ২০১৮ সালের। উৎপাদনের ভাগের হিসাবে পরিষ্কার— চিনের আধিপত্য এতটাই তীব্র যে চট করে তাকে শীর্ষস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আরও পড়ুন: কত কী যে সয়ে যেতে হয় অনন্ত প্রতীক্ষায় ঝুলে থাকতে হলে!

কিন্তু ভারতের কাছে এই মুহূর্তে জরুরি হল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে নিজের ভাগীদারি বাড়িয়ে নেওয়া। চিন শীর্ষে থাকল কি না, তা কিন্তু উৎপাদনের সিঁড়িতে ষষ্ঠ স্থানাধিকারীর মাথাব্যথা হতে পারে না। এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে নির্দিষ্ট ভাবে কিছু শোনা না গেলেও, প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন কথায় এটা স্পষ্ট যে সরকার এই সুযোগ হেলায় হারাতে চাইবে না। এবং এই মুহূর্তে কতটা বিনিয়োগ টানা যায় সেটাই কিন্তু এই লড়াইয়ের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে দেখছে কেন্দ্রীয় সরকার, বিশ্বে প্রথম হওয়াকে নয়। এরই প্রস্তুতিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী— ৪ লক্ষ ৬১ হাজার ৫৮৯ হেক্টর জমি কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট করেছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করেই। এবং না। সেই রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ নেই। যে রাজ্যগুলির নাম আছে সেগুলি হল মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, গুজরাত এবং অন্ধ্রপ্রদেশ।

অনেকেই এর মধ্যে রাজনীতি দেখবেন। কিন্তু রাজনীতিকে পাশে সরিয়ে বিনিয়োগকারীদের চোখে যদি দেখি, তা হলে এই রাজ্যকে নিয়ে, বিশেষ করে উৎপাদন শিল্পের, বড় সংশয় থেকেই গিয়েছে। আজ নয়। বহু দিন ধরেই। উচিত-অনুচিতের যুদ্ধে না গিয়ে যদি রাজ্যে বাম ও বর্তমান সরকারের শিল্প নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি দেখি তা হলে কিন্তু এই খেলায় পশ্চিমবঙ্গের বাদ যাওয়াটাই স্বভাবিক। বিশেষ করে সিঙ্গুর থেকে টাটা মোটরসের বিনিয়োগ বিতাড়নের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প এখনও খুব একটা বিনিয়োগ নীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের উপর আস্থা রাখার জায়গায় ফেরেনি।

আরও পড়ুন: অসময়ের এই সব দিন-রাত, কমে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে কথা বলার সময়

বিনিয়োগ টানতে যে রাজ্যগুলিকে বাছা হয়েছে বলে খবর, সেগুলি কিন্তু দেশের মধ্যে উৎপাদন-বান্ধব হিসাবে পরিচিত। ভুললে চলবে না, বিনিয়োগ টানতে রাজ্যের ভাবমূর্তির একটা বড় ভূমিকা আছে। আর এটা নিয়েই কিন্তু এই রাজ্য লড়ে যাচ্ছে সেই ৯০-এর দশক থেকেই।

তবে পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে দেশের বিনিয়োগের বাজারে যে সংশয়, ভারতের নীতি-স্থিরতা নিয়েও বিশ্বের বিনিয়োগের বাজারে একই সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে স্যামসাঙের অভিজ্ঞতার পরে সেই সংশয় আরও ঘন হয়েছে।

২০১৮ সালে স্যামসাঙ চিন থেকে তাদের মোবাইল তৈরির কারখানা নয়ডায় সরিয়ে আনে। বলা হয় যে এটা বিশ্বের বৃহত্তম মোবাইল তৈরির কারখানা। আর এর ঠিক পরপরই, টিভি প্যানেলের যন্ত্রাংশ আমদানির উপর কর বসানোয় দক্ষিণ কোরিয়ার এই সংস্থাটি চেন্নাইয়ের কারখানার টিভি উৎপাদন ভিয়েতনামে সরিয়ে নিয়ে যায়। ২০১৯ সালে আবার ভারতে উৎপাদন শুরু করে সংস্থাটি, কিন্তু তা নিজের নামে নয়। ডিক্সন নামে একটি সংস্থাকে উৎপাদনের বরাত দিয়ে দেয় তারা।

এই গোটা পর্বটিতে কয়েকটি তথ্য মাথায় রাখতে হবে। চিন থেকে ২০১৮ সাল থেকেই বিভিন্ন সংস্থা বিনিয়োগ সরাতে শুরু করে (যদিও মার্কিন সংস্থারা সে ভাবে এ রাস্তা মারায়নি তখন)। এদের মধ্যে স্যামসাঙ একমাত্র সংস্থা যে ভারতে এত বড় একটি বিনিয়োগ সরিয়ে আনে। বাকিরা বেছে নেয় ভিয়েতনাম ও তাইল্যান্ডকে। মাথায় রাখতে হবে বিনিয়োগে এই চলাচল কিন্তু পুরোটাই ভারতের করনীতির কারণেই। আর বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত যেহেতু লাভ-ক্ষতির উপর নির্ভর করে আর নীতি-অস্থিরতা যেহেতু সেই অঙ্ককে ঘেঁটে দেয়, তাই সংস্থারা সব সময় নীতি-স্থির দেশকেই বেছে নিতে চায়।

ভিয়েতনামের কাছে বিনিয়োগ টানার দৌড়ে ভারতের পিছিয়ে থাকার কিন্তু এটা একটা বড় কারণও বটে। আরও একটা কারণ, যা রাজনৈতিক বিরোধের একটা বড় জায়গা হতে পারে তা হল— উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে শ্রমআইনে শ্রমিকের সুরক্ষা কমিয়ে দেওয়ার অভিযোগ। চিনের বিনিয়োগ টানতে আমরা যদি চিনের রাস্তা অনুসরণ করে শ্রমিকের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করি তাতে শিল্পে অপকার বই উপকার হবে না আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশে। কর্নাটকের আটকে থাকা শ্রমিকদের ট্রেন বাতিল পর্বটিও এই প্রসঙ্গে অনুধাবনযোগ্য। এটা অন্য আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বিনিয়োগ যেমন নীতি-স্থিরতা খোঁজে তেমনই কিন্তু খোঁজে শ্রমশান্তিও। এ ব্যাপারেও রাষ্ট্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই বিনিয়োগ টানার দৌড়ে যদি ভারত পিছিয়ে পড়ে, তা হলে এই দুই কারণেই পড়বে। অশান্তি ও নীতি অস্থিরতার কারণেই। ঠিক যে ভাবে দেশের ভিতরে বিনিয়োগের বাজারে পিছিয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE