Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

জনস্বাস্থ্য মানে শুধু চিকিৎসা নয়

আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ২০০৫ অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা সামলাতে প্রয়োজন কিছু বিশেষ পারদর্শিতা— দক্ষ স্বাস্থ্য-নজরদারি ব্যবস্থা, দ্রুত ব্যবস্থা করার পরিকাঠামো, এবং সর্বোপরি, পরিস্থিতি সামলাতে সমর্থ বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যব্যবস্থা।

সায়ন দাস
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২০ ০০:৩৪
Share: Save:

জনস্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে ধারণার ইতিহাস দীর্ঘ— হরপ্পার উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, গ্রিসে হিপোক্রেটিসের পরিবেশ-ভাবনায় তার স্পষ্ট ছাপ আছে। কোভিড-১৯ অতিমারি সেই প্রাচীন, ফলে অবহেলিত, ধারণাটিকে ফের পাদপ্রদীপের আলোয় আনল। কিন্তু, আরও ডাক্তার, হাসপাতাল, ওষুধ— জনস্বাস্থ্যের দাবি কি শুধু এটুকুই?

আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধি ২০০৫ অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যে জরুরি অবস্থা সামলাতে প্রয়োজন কিছু বিশেষ পারদর্শিতা— দক্ষ স্বাস্থ্য-নজরদারি ব্যবস্থা, দ্রুত ব্যবস্থা করার পরিকাঠামো, এবং সর্বোপরি, পরিস্থিতি সামলাতে সমর্থ বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যব্যবস্থা। অথচ আমাদের গোড়াতেই গলদ। নব্য-উদার অর্থনীতির হাত ধরে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রবেশ ঘটে বেসরকারি পুঁজির। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে ক্রমশ পিছু হটতে থাকে রাষ্ট্র। বাড়তে থাকে বেসরকারি ক্ষেত্রের আধিপত্য। স্বাস্থ্য পরিষেবা পরিণত হয় মুনাফা-উৎপাদক পণ্যে। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়তে থাকে স্বাস্থ্যজনিত অসাম্য।

আজ দেশের দুই তৃতীয়াংশ হাসপাতাল বেড আর আশি শতাংশ ভেন্টিলেটরই বেসরকারি ক্ষেত্রে। অথচ মহামারির শুরুতেই মানুষ প্রত্যক্ষ করলেন বেসরকারি ক্ষেত্রের পিটটান। বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে পরে করোনা-পরিষেবা দিতে বাধ্য করা হলেও, রোগী প্রত্যাখ্যানের অভিযোগ প্রচুর। অন্যান্য চিকিৎসার খরচ বেড়ে আগুন। এ চিত্র শুধু এখনকার নয়, তুলনায় ‘স্বাভাবিক’ সময়েও প্রতি বছর এ দেশে ছ’কোটির কাছাকাছি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যান স্বাস্থ্যের ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে। জনস্বাস্থ্যের বিচার্য তাই শুধু স্বাস্থ্যপরিষেবার অভাব নয়— যে স্বাস্থ্যনীতি, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা এই অসম পরিস্থিতি উদ্ভবের পিছনে, প্রশ্ন তাদেরকে নিয়েও।

রোগাক্রান্ত হলে উপযুক্ত স্বাস্থ্যপরিষেবা দেওয়া তো বটেই, কিন্তু তারও আগে, শারীরিক-মানসিক-সামাজিক ভাবে অর্থাৎ সর্বাঙ্গীণ ভাবে সুস্থ থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন, সেগুলি যথাযথ ভাবে উপস্থিত কি না, সেটা দেখাও জনস্বাস্থ্যেরই কাজ। ডাক্তাররা কোভিড রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসাটুকুই করতে পারেন, কিন্তু যে সমাজ-পরিবেশগত অবস্থায় রোগের জন্ম ও বিস্তার, সে ব্যাপারে খুব কিছু করা তাঁদের সাধ্যের বাইরে। অন্য দিকে, অতিমারির পিছনে থাকা নির্বিচারে প্রকৃতি-বিধ্বংসী আগ্রাসী ‘উন্নয়ন’-এর মডেলও জনস্বাস্থ্যের মাথাব্যথা। এখানেই তফাত প্রধানত স্বাস্থ্যপরিষেবা প্রদানে নিযুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর জনস্বাস্থ্যের। চিকিৎসাশাস্ত্রে যেখানে সুস্থ থাকা মানে মূলত রোগমুক্তি, জনস্বাস্থ্য সেখান থেকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে ভাবে সকলের আর্থসামাজিক সক্ষমতার কথা, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ-বাস্তুসংস্থানের কথা, স্বাস্থ্যের অধিকারের কথাও।

কাজেই, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা কাজকর্ম বন্ধ রেখে বাড়িতে থাকার ফরমান জারি করেই কাজ ফুরোয় না। গরিব-দুঃস্থ মানুষের ঘরে বার বার হাত ধোয়ার মতো জলের জোগান আছে কি না; ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি-অঞ্চলে কী ভাবে দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব; বসে খাওয়ার মতো সঞ্চয় যাঁদের নেই, তাঁদের দিন কী ভাবে চলবে— সব কিছুই জনস্বাস্থ্যের ভাবনার বিষয়। জনস্বাস্থ্যের দায় তাই শুধু স্বাস্থ্য দফতরের নয়। শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজকল্যাণ, পরিবেশ, শ্রম, কৃষি, নগরপরিকল্পনা দফতর— সকলেরই।

তবে, জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত সবাই এক রকম ভাবে ভাবেন না। এক দিকে আছে ফিলানথ্রোক্যাপিটালিজ়ম বা মুনাফাভিত্তিক দাক্ষিণ্য-কেন্দ্রিক গ্লোবাল হেলথ— যেখানে গরিব বা উন্নয়নশীল দেশের জনস্বাস্থ্য-সমস্যা নিয়ে চিন্তিত উন্নত বিশ্বের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান বা বিশেষজ্ঞরা ক্রমাগত বাতলাতে থাকেন প্রযুক্তিনির্ভর দাওয়াই। অভিযোগ, এই অনুগ্রহ যতটা না সমস্যার সমাধান খুঁজতে, তার চেয়ে বেশি পশ্চিমি প্রযুক্তির জন্য আমাদের জনবহুল বাজার ধরতে। কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তির উপযোগিতা অবহেলার নয়, কিন্তু তা যদি বিদ্যমান সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গভীরে প্রোথিত ব্যাধির মূল কারণ থেকেই দৃষ্টি সরিয়ে দেয়, তা হলে সমস্যা। বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট-ও গ্লোবাল হেলথ-এর নব্য-ঔপনিবেশিক ঝোঁক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দেশের বিভিন্ন শ্রেণির সামাজিক পরিস্থিতি, স্থানীয় এপিডেমিয়োলজিক্যাল চরিত্র ভুলে জারি হয়েছিল দেশব্যাপী লকডাউন। তার পিছনেও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন গ্লোবাল হেলথ প্রতিষ্ঠানের মডেল-নির্ভর গণনার উপর অতিরিক্ত বিশ্বাসকেই অনেকাংশে দায়ী করেছে ভারতের তিনটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সংগঠন।

তবে, ভারতে জনস্বাস্থ্যের মূল ধারাটি মেডিক্যাল শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত কমিউনিটি মেডিসিনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বায়োমেডিসিন-নির্ভর এই ধারা বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্য কার্যক্রমের মাধ্যমে সংক্রামক এবং অসংক্রামক ব্যাধিরোধেই মূলত নিযুক্ত। করোনা-অতিমারি রোধে যে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন বা কোয়রান্টিনের ব্যবহার দেখছি, তা এই ধারারই অবদান। এর তাৎপর্য যদিও অনস্বীকার্য, কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত এই ধারায় জনস্বাস্থ্যের বৃহত্তর দায়িত্বের হদিশ মেলে না।

সেখানেই আসে তৃতীয় ধারা, অর্থাৎ সোশ্যাল মেডিসিন বা সামাজিক জনস্বাস্থ্যের ধারণা। লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা, মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তের ক্রমঅপস্রিয়মাণ সঞ্চয়, বাড়তে থাকা বেকারত্ব— স্বাস্থ্যের উপর এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল কী হবে, কী ভাবেই বা তা রোখা সম্ভব, সেই সব আলোচনা, উত্তর খোঁজার ক্ষেত্র এই ধারা। বস্তুত, তিন ধারাতেই গ্রহণযোগ্য অনেক কিছুই আছে, এবং সেই সবের মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব সবার জন্য সর্বাঙ্গীণ স্বাস্থ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করা।

এই প্রচেষ্টা শুধু জনস্বাস্থ্যকর্মী বা বিশেষজ্ঞদের একার সাধ্য নয়। প্রয়োজন সমাজে, জনপরিসরে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, সর্বত্র এই নিয়ে আলোচনা, প্রখর দাবি-দাওয়ার উত্থাপন। সেটা শুধু হাসপাতাল, আইসিইউ-এর চাহিদাতেই সীমিত থাকবে, না কি সংযুক্ত হবে সবার জন্য খাদ্য-বাসস্থান-কাজের অধিকারের দাবি, সুস্থ পরিবেশ-প্রকৃতি, প্রকৃত অর্থে জনকল্যাণকর উন্নয়নের দাবির সঙ্গে, তা নির্ভর করবে জনস্বাস্থ্য বলতে আমরা কী বুঝি, তার উপর। আজ করোনার সুদূরপ্রসারী সামাজিক ক্ষয়ক্ষতিতে হয়তো সেই বোধ, সেই প্রতিবাদের পরিসরটুকু তৈরি হচ্ছে। দেশে দেশে জোরালো হচ্ছে সবার জন্য সুলভ এবং সার্বিক সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার দাবি।

সেন্টার অব সোশ্যাল মেডিসিন অ্যান্ড কমিউনিটি হেলথ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Covid-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE