Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সহনাগরিকের প্রতি সন্দেহ, ছায়াযুদ্ধের মোক্ষম অস্ত্র

বাইরের সন্ত্রাস কখন যেন আমাদের অজান্তেই সিঁধ কেটে ঢুকে পড়ে আমাদের অন্তরে, জায়গা করে নেয় অবচেতনের অলিতে-গলিতে। লিখছেন সাহাবুদ্দিনবিশ্বজুড়ে জাতি, ধৰ্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আছে অসংখ্য জঙ্গিগোষ্ঠী, যাদের মারণ যজ্ঞ একই রকম ঘৃণ্য।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ০২:৫৩
Share: Save:

পুলওয়ামা কাণ্ডের পর তাকে কেন্দ্র করে ছিল রাজনৈতিক তরজা। অথচ, প্রাক্‌নির্বাচনী রাজনৈতিক চাপান-উতোরে প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে নিহত জওয়ানদের পরিবারের কান্না। কিন্তু চাপা পড়া কান্নার ফসিলের দাগ কি মুছে যায় কখনও? ঠিক যেমন মোছে না অবচেতনের দেওয়াল লিখন। ভোটের ভরা বাজারে পুলওয়ামা দেখাল আমাদের অবচেতনের দেওয়াল লিখন। যা দেশের এক নাগরিকের প্রতি আর এক সহনাগরিকের অবিশ্বাসের অক্ষরে লেখা।

পুলওয়ামায় ভারতীয় জওয়ানদের উপর আত্মঘাতী জঙ্গি হানার কয়েক দিন পর আমার এক প্রতিবেশী সহনাগরিক আমায় দেখেই বলে উঠলেন, ‘‘জানেন দাদা, কাগজে ছবি বেরিয়েছে এক মসজিদ ও দরগা কমিটির তরফে কাশ্মীরে নিহত জওয়ানদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মিছিল বেরিয়েছে। দেখে বেশ ভাল লাগল।’’ কথার ভঙ্গিতে স্পষ্ট অবাক হওয়ার ছাপ। এই ভাললাগা আর অবাক হওয়ার দলে ভদ্রলোক একা নন। তাই পাল্টা প্রশ্ন করলাম— এ নিয়ে অনেক মিছিলই তো বেরোচ্ছে। আমিও হেঁটেছি একটা মিছিলে। কিন্তু এতে আলাদা করে ভাল লাগার কী হল?

প্রশ্নটা শুনেই প্রতিবেশী কিঞ্চিত অপ্রস্তুত। আমতা আমতা করে বললেন, ‘‘না, মানে ইয়ে...।’’ অপ্রস্তুত দশা কাটাতে তাঁর কথার মধ্যে কথা দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেলাম। কিন্তু পুরোপুরি যেতে পারলাম কি? একটু একলা হতেই মনে হল, ভদ্রলোকের এই আলাদা করে ভাল লাগাটা অকস্মাৎ আকাশ থেকে পড়েনি। এর একটা বাস্তব রয়েছে, যার শিকড় অনেক গভীরে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

জইশ জঙ্গি আদিল আহমদ দার। পুলওয়ামায় আত্মঘাতী ওই জঙ্গির ভিডিও বার্তাটি একটু ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যায় সেখানে ‘বেহেস্ত’ ‘(স্বর্গ)’ ‘আখেরাত’ (পরকাল), ‘নেক’ (পুণ্য) ইত্যাদি শব্দের সচেতন ব্যবহার। অল্পবয়সী, অশিক্ষিত, দরিদ্র, মুসলিম যুবকদের (কখনও কখনও তথাকথিত শিক্ষিত ও আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল) মগজ ধোলাইয়ের জন্য এই শব্দগুলি যেমন সঞ্জীবনী বটিকা, তেমনই অবশিষ্ট বিশ্বকে, বিশেষ করে অমুসলিম বিশ্বকে অবাক করার পক্ষে যথেষ্ট।

বিশ্বজুড়ে জাতি, ধৰ্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আছে অসংখ্য জঙ্গিগোষ্ঠী, যাদের মারণ যজ্ঞ একই রকম ঘৃণ্য। কিন্তু এ ভাবে সরাসরি ধর্মীয় পরিসরকে হাইজ্যাক করে তাকে জঙ্গি কার্যকলাপে এমন জোশের সঙ্গে যারা ব্যবহার করে তাদেরকে সংশ্লিষ্ট ধর্মের প্রতিনিধি ভাবাটা অন্য অনেক সহনাগরিকের কাছে হয়তো স্বাভাবিক মনে হয়। এটা গ্রাউন্ড রিয়ালিটি। কিন্তু সত্য কী? সত্য আর বাস্তবের গূঢ় দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব উদ্‌ঘাটনের ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি না। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, পয়গম্বর মহম্মদ (স)-এর নাম ও তাঁর ইসলামকে হাইজ্যাক করে তথাকথিত ইসলামিক ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠার খোয়াব নিয়ে যে সব জঙ্গিগোষ্ঠী বিশ্ব জুড়ে তথাকথিত মহম্মদীয় জোশ দেখাচ্ছে, তাদের জেহাদের সঙ্গে কি পয়গম্বর মহম্মদ (স)-এর জোশ ও জেহাদকে আদৌ মেলানো যায়? জইশ-ই-মহম্মদ কেন, যে কোনও জঙ্গির কাপুরুষোচিত জোশ তথা ঘৃণ্য শৌর্য আত্মঘাতী জঙ্গিকে নিরপরাধ মানুষ মারার বিনিময়ে যে বেহেস্তের খোয়াব দেখায় তার ঠিকানা মহম্মদ (স) দূরের কথা, স্বয়ং আল্লাহও জানেন না। যে কোনও শুভচেতনা সম্পন্ন মানুষের কাছে এটাই সত্য। আর এ সত্য আপন শক্তি ও স্বকীয়তায় ছাপিয়ে যায় যে কোনও গ্রাউন্ড রিয়ালিটি বা স্থানিক বাস্তবতাকে। সে জন্যই আজও পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই স্থানিক বাস্তবতার সঙ্কীর্ণ পরিসর ছেড়ে আস্থা রাখেন প্রকৃত সত্যে। তাঁদের কাছে প্রকৃত সত্য হল, শুধু ইসলাম কেন, কোনও ধর্মই সন্ত্রাসের সমার্থক নয়। তাঁরা বিশ্বাস করেন, জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের সমান যদি হয় মারণ সন্ত্রাস, তা হলে ধর্মের মান শূন্য।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই সরল পাটিগণিতের মতো সহজ সত্যকে সহজিয়া চেতনায় না রেখে স্থানিক বাস্তবকে সত্য হিসেবে ধরে নিয়ে তাকে অনেকেই স্থান দেন নিজস্ব চেতনায়। আর একেকটা পুলওয়ামা, উরি, পাঠানকোট কিংবা মুম্বই হামলা তখন তাঁদের অবচেতনের দেওয়াল লিখনকে সামনে এনে দেয়। আর সে জন্যই বোধ হয় ধর্মের নামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোনও মসজিদ বা দরগা কমিটি মিছিল করলে অনেক সহনাগরিকের একটু আলাদা করে ভাল লাগে। শুধু ভালই লাগে না কিঞ্চিৎ অবাকও করে। যেন তাঁরা মনের অবচেতনে ধরেই নেন, ইসলামিক কোনও প্রতিষ্ঠান এই নাশকতার বিরুদ্ধে যেতেই পারে না। তাঁরা বেমালুম ভুলে যান কিংবা চেপে যান, পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গির নাম আদিল হলেও তাকে বিস্ফোরক সরবরাহকারীর নাম অঙ্কিত। ঠিক যেমন পশ্চিমের দেশগুলিতে মাঝে মাঝেই হামলাকারী অমুসলিম শ্বেতাঙ্গ বন্দুকবাজদের, এমনকি সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের আল-নুর মসজিদে হামলাকারীকে কেউ কেউ নিছক মানসিক ভারসাম্যহীন বলে তাদের নাশকতাকে হাল্কা করে দেখেন।

সাফ কথা, জঙ্গি নাশকতার বিরুদ্ধে মসজিদ বা দরগা কমিটি মিছিল বের করলে যদি কারওর ভাল লাগে, সেই ভাললাগার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু অবাক হওয়ার মধ্যে একটা অসুখ আছে। কী তার উৎস? সে কি শুধু সন্ত্রাসবাদীর হাতে ইসলামের হাইজ্যাকিং? ধর্মের সঙ্গে সন্ত্রাসকে গুলিয়ে ফেলার যে অশিক্ষা একটি বিশেষ ধর্মের সঙ্গে সন্ত্রাসকে সমার্থক ভাবতে শেখায়, সে অশিক্ষাও কি এর অন্যতম উৎস নয়? ধর্মের হাইজ্যাকিং যদি হয় গ্রাউন্ড রিয়ালিটি বা স্থানিক বাস্তব তো অশিক্ষা হল চিরসত্য। এই অশিক্ষাকে যাঁরা বয়ে নিয়ে চলছেন আজও তাঁদের অবচেতনের দেওয়াল লিখন লেখা হয় অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি সন্দেহের অক্ষরে।

পুলওয়ামা পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সেই অক্ষরকে আরও একবার চিনিয়ে দিল, যা পড়তে রীতিমতো অস্বস্তি হয়। কারণ, একই দেশের মাটিতে একই উদ্দেশ্যে যখন একটা বিশেষ ধর্মের মানুষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিছিল করলে তাকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখা হয়, এবং তাঁদেরকে বিশেষভাবে প্রমাণ দিতে হয় তাঁরাও ভারতীয়, তখন বেশ অস্বস্তি লাগে। তাদের মিছিল দেখে এক জন সহনাগরিক যখন অবাক হচ্ছেন, তখন অন্য জন উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে হচ্ছেন অপ্রস্তুত। এই অবাক হওয়া আর অপ্রস্তুত হওয়ার মনোজাগতিক অসুখে আমরা আজ আক্রান্ত অনেকেই। বাইরের সন্ত্রাস কখন যেন আমাদের অজান্তেই সিঁধ কেটে ঢুকে পড়ে আমাদের অন্তরে, জায়গা করে নেয় অবচেতনের অলিতে-গলিতে। যেমন, ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচের সময়ে আমাদের অন্তরে অবচেতনের ছায়যুদ্ধ হয়ে ঢুকে পড়ে মুম্বই বিস্ফোরণ, উরি, পাঠানকোট, পুলওয়ামা।

সে ছায়াযুদ্ধের অস্ত্র কেমন? দীর্ঘ দিনের চেনা সহনাগরিকের অচেনা চাউনি, বন্ধুর বক্রোক্তি, সন্দেহ, পাশ কাটিয়ে যাওয়া— যা অসহ্য। আইইডি বিস্ফোরণের চেয়ে তা কি কম কিছু? বাইরের রক্তস্নানের চেয়ে অন্তরের রক্তক্ষরণ কি কোনও অংশে কম হয় নাকি?

যে সন্ত্রাসবাদী পরকালের স্বর্গসুখের বিকারগ্রস্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আত্মঘাতী হল, সে তো মূর্খের মতো রক্তস্নান সেরে চলেই গেল পৃথিবী ছেড়ে। পৃথিবীতে থেকে গেল সংশ্লিষ্ট ধর্মানুসারী যে কোটি কোটি মানুষ, তারাই হয় এই অন্তরলোকের ছায়াযুদ্ধের শিকার। ভিতরের রক্তক্ষরণটা তাদেরই বেশি হয়। সর্ব কালে সর্ব দেশে সংখ্যাধিক্য ও ক্ষমতার জোর সগর্বে আছড়ে পড়ে সংখ্যালঘুর উপর। মানসিক ও আত্মিক ভাবে দীর্ণ হতে হতে জীর্ণ হয়ে পড়ে সেই সব সংখ্যালঘু মানুষের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। রুদ্ধ হয়ে পড়ে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও সৃজনশীলতা। বৃহত্তর সমাজ আখেরে হারায় এক বিপুল সম্ভাবনা। আমরা কি তার খবর রাখি ?

প্রত্যক্ষ হামলা বা শারীরিক নিগ্রহ পর্যন্ত না গড়ানো পর্যন্ত মনোজগতের এই সন্ত্রাস ও ছায়াযুদ্ধ সচরাচর খবরের শিরোনামে আসে না। কিন্তু অন্তরের এ ছায়াযুদ্ধ চলতেই থাকে। বিশেষ করে, ভোটের ভরা বাজারে মেরুকরণের রাজনীতির ঘোলাজলে সে আরও কদর্য চেহারা নিচ্ছে। পুলওয়ামা কাণ্ডের পর সে এতটাই প্রকট যে মাঝে মাঝে আমাদের শেখাচ্ছে দেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতার নতুন পাঠ। যা সহনাগরিককে ইচ্ছেমতো সন্দেহ করে, প্রয়োজনে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার জোশ দেখায়। ভোটের বাজারে তথাকথিত দেশপ্রেম, ফাঁপা উন্নয়ন ও লোকদেখানো সম্প্রীতির দেওয়াল লিখনের নীচে আর কতদিন লুকিয়ে থাকবে পারস্পরিক অবিশ্বাসের অক্ষরে লেখা আমাদের অবচেতনের দেওয়াল লিখন?

মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব

লেখক শক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE