Advertisement
E-Paper

পোশাক-বার্তা

ভারতীয় প্রহরীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছাড়িয়া হঠাৎ সেনার পোশাক গায়ে চড়াইয়া প্রহরীরা গণতান্ত্রিক সংসদে উপস্থিত হইলে যখন বিরোধীরা সমালোচনায় মুখর হন— বিজেপি সাংসদদের তখন উত্তর ছিল যে, তাহা কেন, বরং ‘ঐতিহ্যবাহী’ পোশাকের মধ্যেই তো ব্রিটিশ যুগের ছাপ রহিয়াছে।

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৫৬
পোশাক বদলে বিতর্ক।

পোশাক বদলে বিতর্ক।

কিছু কিছু দৃশ্য অনেক বেশি কিছু বলিয়া দেয়। কতখানি, তাহা হয়তো গোড়ায় ঠাহরই করা যায় না। ক্রমশ উপলব্ধি হয় যে দৃশ্যটি আকস্মিক নহে, অকারণও নহে, বরং অত্যন্ত গভীর অর্থবাহী, যে অর্থ দর্শকের চোখে সচরাচর ধরা পড়ে না। সংসদের শীতকালীন অধিবেশন আরম্ভ হইতেই রাজ্যসভায় যে ছবিটি দেখা গেল, রাজ্যসভার চেয়ারপার্সনের আসনের পাশে মিলিটারি ইউনিফর্ম পরিহিত দণ্ডায়মান মার্শালদের অবয়ব— তাহা দেখিয়া কেহ যদি ভাবেন এই দৃশ্যের মধ্যে ভারতীয় রাষ্ট্রের দ্রুত পরিবর্তনশীল চরিত্রটি মোক্ষম ভাবে ধরা পড়িতেছে, তাঁহাকে দোষ দেওয়া যাইবে না। শাসক দল প্রথমে বিষয়টিকে পাত্তা না দিতে চাহিলেও প্রাক্তন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের একাধিক বার প্রশ্ন উত্থাপনের ফলে নজর এড়ানো মুশকিল হইয়াছে, দেশে সামরিক আইন জারি হইতেছে কি না এমন একটি ব্যঙ্গ সংসদ-চত্বরে ধ্বনিত হইতে শুরু করিয়াছে, শেষ পর্যন্ত চেয়ারপার্সন বেঙ্কাইয়া নায়ডু বলিতে বাধ্য হইয়াছেন যে ব্যাপারটির পুনর্বিবেচনা হউক। বিষয়টিতে যে অবশেষে তাঁহার মনোযোগ ধাবিত হইয়াছে তাহা সুসংবাদ। কারণ, যিনি যাহাই বলুন, পোশাক সত্যই কেবল বহিরঙ্গের বস্তু নহে, অন্তরঙ্গের দিক দিয়া তাহার বিশেষ ব্যঞ্জনা অবশ্যস্বীকার্য।

ভারতীয় প্রহরীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছাড়িয়া হঠাৎ সেনার পোশাক গায়ে চড়াইয়া প্রহরীরা গণতান্ত্রিক সংসদে উপস্থিত হইলে যখন বিরোধীরা সমালোচনায় মুখর হন— বিজেপি সাংসদদের তখন উত্তর ছিল যে, তাহা কেন, বরং ‘ঐতিহ্যবাহী’ পোশাকের মধ্যেই তো ব্রিটিশ যুগের ছাপ রহিয়াছে। অথচ, শাসক দলের সাংসদদের জানিবার কথা যে প্রথাগত দেশীয় পোশাক যতখানি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইঙ্গিতবাহী, তাহার অপেক্ষা অনেক বেশি করিয়া সামরিক পোশাক গণতন্ত্রবিরোধী কর্তৃত্ববাদের বার্তাবাহী। ভারতীয় নাগরিক সমাজ উত্তমরূপে অবগত যে, সামরিক পোশাক একটি শৃঙ্খলাবদ্ধতার কথা বলে— নির্বাচিত প্রতিনিধি-সভায় যাহা অত্যন্ত বেমানান। এবং অতি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সেই প্রয়াসের মধ্যে কর্তৃত্ববাদের ছায়া দেখিতে পাওয়া মোটেই দুরূহ নহে।

বাস্তবিক, হঠাৎ করিয়া সামরিক ইউনিফর্মের প্রসারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের (অতি)শৃঙ্খলাপরায়ণ হইবার ঘটনা আধুনিক পৃথিবীতে বারংবার ঘটিতে দেখা গিয়াছে। দৃষ্টান্ত খুঁজিতে মুসোলিনির ইটালি কিংবা হিটলারের জার্মানির দিকে তাকাইবার প্রয়োজন নাই। মাত্র তিন দশক আগের ব্রাজিলের দিকে তাকাইলেও বোঝা যাইবে, কেমন আকস্মিক ভাবে ভোল পাল্টাইয়াছিল সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী, রাতারাতি তাহাদের গায়ে চড়ানো হইয়াছিল সামরিক পোশাক, এবং প্রতিবাদে ফাটিয়া পড়িয়াছিল সে দেশের গণপরিসর। তুরস্কের মতো মিলিটারি-শক্তিপ্রধান দেশও এই প্রবণতার সহিত আত্যন্তিক পরিচিত। লক্ষণীয়, কেবল সামরিক পোশাকই কর্তৃত্ববাদের প্রিয় নয়। অন্য ইউনিফর্মও আছে। ভারতের বর্তমান শাসক দলের উৎসপ্রতিম প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ শৃঙ্খলাবদ্ধতার প্রয়োজনেই এমন অন্য ধরনের ইউনিফর্মের প্রচলন করিয়াছিল। আরএসএস-এর সেই ইউনিফর্মপ্রীতির পথ ধরিয়াই কি বিজেপি-শাসিত দেশের সংসদে মার্শালদের পরিচ্ছদ পাল্টাইতে বসিয়াছিল? এ-হেন অনুমানরেখা অসঙ্গত নহে। এই দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ক্রমেই বহুত্ববাদের স্থান লইতেছে একবাদ, এক-সংস্কৃতির সঙ্কীর্ণতা। দেশীয় সমাজের মধ্যে স্তরে স্তরে প্রবিষ্ট যে ভিন্নতা ও বিভিন্নতার ধারা, তাহা উৎখাত করিয়া দিনরাত চলিতেছে একমাত্রিক সমাজ নির্মাণের প্রচেষ্টা। এবং সেই প্রচেষ্টাকে মহিমান্বিত করা হইতেছে জাতীয়তাবাদের নামে। এখন, এই প্রচেষ্টাকে ভারতের বহুত্ববাদ ও ভারতের গণতন্ত্র কী ভাবে সামলাইবে, আদৌ সামলাইতে পারিবে কি না, অদূর ভবিষ্যৎ তাহা বুঝাইয়া দিবে।

Parliament Dress Code Marshal Uniform Rajya Sabha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy