Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্বাসের এই শিখাটুকু যেন নিভে না যায়

সারাজীবন ধরে তিনি হিন্দু-মুসলমানের ‘কমন কালচারে’র কথাই বলে গিয়েছেন। যে ‘কমন কালচার’ তৈরি হয় প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাব-ভাষা-রুচির লেনদেনে। আজ, ৫ নভেম্বর সেই রেজাউল করীমের মৃত্যুদিন।লিখছেন সুদীপ জোয়ারদার পরবর্তী কালে এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রেজাউল করীম লিখেছেন, ‘‘সে-যুগে দেশবন্ধুর বক্তৃতা যারা শুনেছে, তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কি আবেগ, কি উচ্ছ্বাস, কি অন্তরের আহ্বান। আমরা অনেকেই সে ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না।’’

রেজাউল করিম।

রেজাউল করিম।

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৯ ০২:২২
Share: Save:

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের কাছে একটা পার্কে ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন চিত্তরঞ্জন দাশ। কলেজের অনেক ছাত্র এসে ভিড় করেছেন সেখানে। সে দলে ছিলেন তিনিও। মহাত্মা গাঁধী তখন ডাক দিয়েছেন অসহযোগ আন্দোলনের। সেই আন্দোলনে সকলকে শামিল হতে হবে, এই নিয়েই ছিল দেশবন্ধুর বক্তৃতা। একে গাঁধীজি ছিলেন প্রাণের মানুষ, তার উপরে দেশবন্ধুর আবেগময় বক্তৃতা। তিনি ওই সমাবেশে দাঁড়িয়েই স্থির করে ফেললেন লক্ষ্য। আর লেখাপড়া নয়, করবেন দেশের কাজ।

পরবর্তী কালে এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রেজাউল করীম লিখেছেন, ‘‘সে-যুগে দেশবন্ধুর বক্তৃতা যারা শুনেছে, তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কি আবেগ, কি উচ্ছ্বাস, কি অন্তরের আহ্বান। আমরা অনেকেই সে ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না।’’ (আমার ছেলেবেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ অগস্ট, ১৯৮৫)

সেন্ট জেভিয়ার্সের পড়া ছেড়ে করীম ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশের কাজে। এই সময় অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রে বেশ কয়েক বছর তাঁকে ঘুরতে হল গ্রামে গ্রামে। অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা ভিন্ন ব্যাপার, কিন্তু তাঁর তরুণ মনে যে আবেগ সে দিন দেশ ঘিরে গড়ে উঠেছিল তা পরবর্তী কালেও অটুট ছিল।

তবে যে কারণে আজও রেজাউল করীম প্রণম্য, প্রাসঙ্গিক এবং অনুসরণযোগ্য তা তাঁর স্বদেশপ্রেমের অঙ্গ হলেও আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। করীম ছিলেন এ বাংলায় সমন্বয় ভাবনার চিরপথিক এক ব্যক্তিত্ব। সারাজীবন ধরে তিনি হিন্দু-মুসলমানের ‘কমন কালচারে’র কথাই বলে গিয়েছেন। যে ‘কমন কালচার’ তৈরি হয় প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাব-ভাষা-রুচির লেনদেনে।

করীমের মতে, বৈচিত্র কিছু থাকবেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হবে। প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হয়ে ঐক্যের ধারাটি বজায় রেখে চলার মধ্যেই রয়েছে জাতি হিসাবে সার্থকতা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর এই সমন্বয় ভাবনায় বার বার আঘাত এসেছে। চল্লিশের দশকে এই সমন্বয়ের কথা বলে আক্রান্তও হয়েছেন। তবুও নিজের মত ও পথ থেকে কোনও দিন সরেননি। যে কোনও মনীষী তাঁর জন্ম ও মৃত্যদিন এলেই আমাদের বিস্মরণের ধুলো সরিয়ে দিন কয়েকের জন্য চর্চার টেবিলে উঠে আসেন। রেজাউল করীমকে (মৃত্যুদিন ৫ নভেম্বর, ১৯৯৩) কিন্তু সে ভাবে নেড়েচেড়ে আবার রেখে দেওয়া যাবে না। ধর্মীয় মেরুকরণের প্রবল প্রচেষ্টার এই যুগে রেজাউল করীম নতুন করে হতে পারেন সমন্বয়ী ভাবনার উদ্্গাতা। এই অস্থির সময়ে তাঁর লেখা আমাদের ফিরে পড়া খুব বেশি করে দরকার।

ভাবলে অবাক লাগে করীম জন্মেছিলেন এমন এক পরিবেশে যেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল, ছিল হাজারো সংস্কারের বেড়াজাল। তবুও সে সব কাটিয়ে ধর্মীয় উদারতা এবং মুক্ত চিন্তায় তিনি সারাজীবন ধরে অবগাহন করে গিয়েছেন। আর চারপাশের মানুষদের চেষ্টা করেছেন তার শরিক করার। কখনও তা ঐক্যের ধারণায়, কখনও তা বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে আপন সম্প্রদায়ের কিছু ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনে, কখনও নয়া ভারতের ভিত্তির প্রশ্নে, কখনও দারাশিকো, আলবেরুনির উপর নতুন আলোকপাতে।

‘তিনি এক জন শক্তিশালী, চিন্তাশীল ও নির্ভীক লেখক ও যথার্থ জাতীয়তাবাদী’, ‘নয়া ভারতের ভিত্তি’র ভূমিকায় এ কথা লিখেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এই জায়গায় পৌঁছতে করীমকে হাঁটতে হয়েছিল বিস্তর পথ। তাঁর সৌভাগ্য বাড়ির পরিবেশটা পেয়েছিলেন অনুকূলে। পিতা আবদুল হামিদ ইংরেজি জানতেন না, কিন্তু আরবি, ফারসি জানতেন বেশ ভাল।

অগ্রজ দুই ভাই, কলকাতার কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছিলেন। বড় ভাই মঈনুদ্দীন হোসাইনের সঙ্গে যোগ ছিল বিপ্লবী সমিতির। নজরুলের কবি হিসাবে গড়ে ওঠার পর্বে তিনি ছিলেন তাঁর বিশেষ সাহায্যকারী বন্ধু। সুতরাং করীমের বিদ্যাচর্চায়, মানসিকতা নির্মাণে বাড়ির মানুষদের অনেকটাই ভূমিকা ছিল। আর পরবর্তীতে যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের আলোয় নিজেকে তিনি যে আরও প্রদীপ্ত করে তুলেছিলেন সেখানে কখনও সহায়ক হয়েছিল টমাস পেন, লেকি ইত্যাদি পশ্চিমী সমাজবিজ্ঞানীদের বই আবার কখনও মৌলানা আজাদের মতো দেশীয় চিন্তাবিদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণাসঞ্চারকারী লেখা ।

পড়াশোনা ছিল তাঁর জীবনের আর এক ব্রত। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার্জনও সেন্ট জেভিয়ার্স পর্বের সাময়িক ছেদ কাটিয়ে আবার শুরু করেছিলেন। অসহযোগের আলোড়ন স্তিমিত হয়ে এলে করীম ফিরে এসেছিলেন স্বভূমির দিকে। তবে জন্মস্থান বীরভূম নয়, মুর্শিদাবাদের সালারে জাতীয় বিদ্যালয়ে অবৈতনিক শিক্ষক হিসাবে।

সে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে আবার শুরু হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ইংরেজি নিয়ে বিএ সম্পূর্ণ করে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। তার পরে বহরমপুর গার্লস কলেজে শিক্ষকতা সূত্রে পাকাপাকি ভাবে বহরমপুরই হয়ে ওঠে তাঁর আবাসস্থল। তিরিশ বছর বহরমপুর গার্লস কলেজে তাঁর শিক্ষাদান এই শহরের এক আলোকিত অধ্যায়। সে অধ্যায়ের অনেক হীরক স্মৃতি আজও ঘুরে বেড়ায় বহরমপুরের আনাচকানাচে।

রাজনীতির সঙ্গে যোগ ছিল। ১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সভ্যপদ লাভ করেছিলেন। প্রদেশ কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতিও হয়েছিলেন এক সময়। তবে রাজনীতির সঙ্গে যোগ থাকলেও রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে নিজেকে জড়াননি কখনও। ১৯৭১ সালে লোকসভা নির্বাচন জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে প্রতিপক্ষ ত্রিদিব চৌধুরীর বিরুদ্ধে একটা বিরূপ মন্তব্যও (নির্বাচনে যা দস্তুর) তাঁর মুখ থেকে বের হয়নি। বরং উল্টে বলেছিলেন, ‘‘আমার থেকে ঢাকু (ত্রিদিব চৌধুরীর ডাকনাম) কাজের মানুষ। আপনারা ওকেও ভোটটা দিতে পারেন। আর যদি জাতীয় কংগ্রেসের মতাদর্শে বিশ্বাসী হন, তা হলে আমাকে ভোট দেবেন।’’ সে বার জিততে পারেননি করীম কিন্তু আসলে জিতেছিলেন তিনিই। বিনয়ে, রাজনৈতিক সৌজন্যে।

জীবনের উপান্তে দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন করীম। বুঝেছিলেন, যে ভারতের ছবি সেই বাল্যকাল থেকে মনে মনে এঁকেছেন, তা ম্লান হচ্ছে কোথাও। তবুও ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’— রাবীন্দ্রিক এই ভাবনাতেই আস্থা রেখে গিয়েছেন। এবং কামনা করেছেন, বিশ্বাসের এই শিখাটুকু নিভে যাক, এমন ঝড় যেন না ওঠে।

শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল

তথ্যঋণ: ‘এ চিন্তার মৃত্যু হবে না কোনদিন’ (রেজাউল করীমের সাক্ষাৎকার: আবুল বাশার, দেশ, ১০ অগস্ট, ১৯৯১)। ছবি সৌজন্য: রেজাউল করীমের বর্তমান পরিবার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rejaul Karim Hindu Muslim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE