Advertisement
E-Paper

ঋতুমতী নারীর প্রতি ধর্মের এই রক্তচক্ষু হাস্যকর

শবরীমালা আন্দোলন একটি পথ মাত্র, যা প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে কিছুটা অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে। লিখছেন লিপিকা বিশ্বাস সাহাআসল কথা হল, এই নারী রজঃস্বলা হলেই সৃষ্টি রক্ষা পায়। ঋতুমতী নারীই তো সন্তানের ধারক ও বাহক। তাই ধর্মের এই রক্তচক্ষু নিতান্তই হাস্যকর।

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:৪৬
ঋতুমতী নারীই তো সন্তানের ধারক ও বাহক। তাই ধর্মের এই রক্তচক্ষু নিতান্তই হাস্যকর।

ঋতুমতী নারীই তো সন্তানের ধারক ও বাহক। তাই ধর্মের এই রক্তচক্ষু নিতান্তই হাস্যকর।

মনুসংহিতা’তে বলা হয়েছে, ‘‘যে দিন প্রথম রজঃদর্শন হবে সে দিন থেকে তিন রাত্রি পর্যন্ত রমণী সবকিছু পরিত্যাগ করে ঘরের মধ্যে সর্বদা আবদ্ধ থাকবে। যাতে অন্য কেউ তাকে না দেখতে পায়। স্নান করবে না, অলংকার পরবে না। এক বস্ত্র পরিধান করবে। দীনাভাবে মুখ নিচু করে বসে থাকবে। কারও সঙ্গে কোনও কথা বলবে না। নিজের হাত, পা ও চোখ থাকবে স্থির। দিনের শেষে মাটির হাড়িতে তৈরি করা ভাত সে খাবে এবং ভূমিতে সাধারণ ভাবে শয্যা করে নিদ্রা যাবে।’’ এ ছাড়া ‘মনুসংহিতা’য় আছে— ‘‘রজস্বলা নারীতে যে পুরুষ সঙ্গত হয় তার বুদ্ধি, তেজ, বল, আয়ু ও চক্ষু ক্ষয় পায়। নারী হল নরকের দ্বার।

কিন্তু আসল কথা হল, এই নারী রজঃস্বলা হলেই সৃষ্টি রক্ষা পায়। ঋতুমতী নারীই তো সন্তানের ধারক ও বাহক। তাই ধর্মের এই রক্তচক্ষু নিতান্তই হাস্যকর।

এ সব মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে যে সংস্কারের চেষ্টা একেবারে হয়নি তা-ও নয়। এ ক্ষেত্রে উনবিংশ শতকের সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বা স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে বিশ্বাসী ভগিনী নিবেদিতার কথা বলা যায়। কিন্তু তাঁরা যদি এখন এই ধর্মের রাজনীতির যুগে জন্ম নিতেন, তা হলে কতটুকু কী পারতেন সে ব্যাপারে ঘোর সন্দেহ রয়েছে। রাজা রামমোহন রায় হিন্দুধর্মে কুসংস্কারের ব্যাপ্তি দেখে এর আমূল সংস্কারের চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রায় আলাদা একটি ধর্মমত চালু করেছিলেন। যদিও সেই ব্রাম্মধর্ম কালের বিবর্তনে হিন্দুধর্মে লীন হয়ে গিয়েছে। কারণ, কুসংস্কারের শক্তি ব্যাপক ও সর্বগ্রাসী।

আরও পড়ুন: শবরী-অর্ডিন্যান্স চেয়ে বাম তোপে কেরলের কংগ্রেস

তবে শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক এ ব্যাপারে পথপ্রদর্শক। নারীদের ঋতুস্রাবের সময় অপবিত্র মানার ঐতিহ্যকে তিরস্কার করে তিনি এই বার্তা দেন যে, একজন ঋতুমতী নারী পবিত্র এবং এই মাসিক চক্র ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।

আসলে ধর্ম হল সেই সব আচারের মধ্যে, যার দ্বারা জীব রক্ষা পায়। আর যার দ্বারা জীব ধ্বংস হয়ে যায়, সেটা হল অধর্ম। কুমারী পুজো, ঋতুমতি মেয়েদের মন্দির প্রবেশ, জাতপাত, বৈদিক সায়েন্স— এই সব কিছুই ধর্মের নামে মানুষের দুষ্কর্ম, প্রকৃত ধর্ম নয়। ঋতুস্রাব নারীদেহের একটি স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া হলেও একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক মানুষেরা এটিকে ট্যাবু ও নিষিদ্ধ বানিয়ে রেখেছে।

আরও পড়ুন: শো-কজ় পুরোহিতকে, মন্দিরে তৃতীয় মহিলা

এখন প্রশ্ন হল, রজস্বলা নারীদের কি ধর্মীয় অধিকার নেই? সমস্যার মূলে তা হলে রয়েছেন ঋতুমতী মহিলারা। সংবিধান যতই মহিলাদের সমানাধিকার দিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ভাবে নারীরা এখনও সমানাধিকার পায় না। একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেটের যুগেও আমাদের সমাজে দু’টি জাতি—নারী ও পুরুষ। বলতে দ্বিধা নেই এখনও আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। ঘরে বাইরে সর্বত্র মহিলারা শোষিত, নিপীড়িত, লাঞ্চিত।

যদিও সমাজে অধিকাংশ লোকাচার সবটাই নারীকেন্দ্রিক। আর সব লোকাচারই উর্বরতা বা উৎপাদনশীলতার কামনায়। প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা থেকে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার ভিত্তি ছিল কৃষি। রজস্রাব শুরু হলেই নারীর নারীত্বের পূর্ণবিকাশ পথ উন্মুক্ত হয়। রজবতী নারী আর শস্যবতী বসুধা দুই সমান। সেই সুপ্রাচীন কালে, পরিবার বা গোষ্ঠীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর শস্যাদি উৎপাদন, দুই-ই ছিল জীবন সংগ্রামের অন্যতম দুটি সিঁড়ি। গোষ্ঠীবদ্ধ স্থায়ী জীবনে কৃষির জন্য, বাঁচার জন্য নারীই তখন ভরসা, কৃষিকাজের শ্রষ্টা। আর নারীর অন্তর্নিহিত প্রাণদায়ী শক্তিই রজস্রাব।

বেদ, উপনিষদ, পুরাণ নারীকে সম্মানের আসনে বসিয়েছিল। মৈত্রেয়ী, গার্গী, অপালা, লোপামুদ্রার মতো বিদূষীরা আজও স্মরণীয়। কিন্তু পরবর্তী কালে সমাজ ও শাসকগোষ্ঠীরা নারীর কাছ থেকে ধীরে ধীরে অনেক অধিকারই কেড়ে নিয়েছে। শুরু হয়েছে কৌলীন্যপ্রথা, বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহের অভিশাপ। নারী হল বিকিকিনির পণ্য। ধর্মের মোড়কে শুরু হল নারী নির্যাতনের বীভৎস বিলাস। সুদীর্ঘকাল ধরে মেয়েরা শুধু ভোগ্যপণ্য ও সন্তান উৎপাদনের আধার, নারী কখনই মানুষ হিসাবে বিবেচিত নন।

নারীর ঋতুস্রাব একটি প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক, জৈবিক প্রক্রিয়া হলেও আধুনিক মানুষেরা ধর্মের নামে প্রাচীন অন্ধবিশ্বাসকে ভাঙতে পারেনি। বরং নারীকে করে রেখেছে অবহেলিত। ধর্মের নামে, শুদ্ধকরণের নামে পঞ্চগব্য অর্থাৎ গোমূত্র, গোবর, দুধ, দই, ঘি এই পাঁচটি জিনিস একত্রে মিশিয়ে তাঁরা অনায়াসে খেতে পারেন। কিন্তু রজঃস্বলা নারীকে অপবিত্র ও অশুচি বানিয়ে অস্পৃশ্য করে রাখে এই ধর্মাচার।

শবরীমালা আন্দোলন এর বিরুদ্ধে একটি পথ মাত্র, যা প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে কিছুটা অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। তবে শুধুমাত্র লড়াই করে অর্ধেক আকাশের অধিকার নেওয়ায় প্রকৃত নারী উন্নয়ন সম্ভব নয়। চাই অখণ্ড ভুবন, যেখানে নারী বা পুরুষ এই পরিচয়ের চেয়ে বড় হবে মানব পরিচয়। আমরা হব সংস্কারহীন সমাজের অমৃতের সন্তান!

শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক

শবরীমালা Sabarimala
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy