Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সন্তোষকুমার ঘোষের শতবর্ষ (১৯২০-১৯৮৫)

মুহূর্তেই গলে জল

বৌদি ছিলেন ভারী ভালমানুষ। খুব শান্ত, ধীর, স্থির, বেশি কথা বলতে কখনও শুনিনি তাঁকে।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share: Save:

সন্তোষকুমার ঘোষ এমন এক মানুষ যাঁর ভিতরে নানা বৈপরীত্যের সমাবেশ। এক দিকে তিনি এক জন অতি সংবেদনশীল সাহিত্যকার, আবার এক জন বাঘা সাংবাদিক। কিন্তু তিনি নিজেও ঠাহর করতে পারেননি যে, আসলে তিনি প্রকৃতপক্ষে কোনটা। এক দিন এক পানশালায় সামান্য পান করার পর তিনি নিজের সাংবাদিক কৃতিত্ব নিয়ে একটু বড়াই করছিলেন। আমি পানে আসক্ত নই জেনেও সন্তোষদা আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন বোধ হয় তাঁর ব্যথাবেদনার কথা বলতেই। সাহচর্য দেওয়ার জন্য। পাশের টেবিল থেকে হঠাৎ হামদি বে উঠে এসে বললেন, তুমি এক জন জার্নালিস্ট বলে বড়াই করছ? তোমার লজ্জা করছে না? তুমি যে এক জন রাইটার তা কি ভুলে গেছ? এক জন সাহিত্যিক হয়ে নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে জাহির করাটা তো আহাম্মকি! সন্তোষদা বেশ লজ্জা পেয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করার একটু ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন মনে আছে।

এক দিন আমাকে বলেছিলেন, জানো, আগে এ রকম মদের নেশা আমার ছিল না। যখন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড থেকে আমি আনন্দবাজার পত্রিকার নিউজ় এডিটর হলাম তখন আমার বেতন অনেক বেড়ে গেল। এত টাকা দিয়ে কী করব তা বুঝতে না পেরে হঠাৎ মদের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। কথাটা শুনে আমি একটু হেসেছিলাম। অথচ মানুষটির গুণপনারও সীমা ছিল না। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব প্রায় কিংবদন্তির মতোই। সম্ভবত সাংবাদিকতার আগ্রাসনে তাঁর সাহিত্যসত্তা ম্লান হয়ে গিয়েছিল।

এক দিকে ছিলেন প্রচণ্ড রাগী। এক দিন দেখা গিয়েছিল তিনি একটি লোককে ঘাড় ধরে ঘর থেকে বার করে প্যাসেজ দিয়ে সিঁড়ির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অন্য দিকে দারুণ নরম মনের আবেগপ্রবণ, ক্ষমাশীল, স্নেহপ্রবণ মানুষ। এক জন তরুণ লেখকের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে তিনি গুরুতর আহত হন। খবর পেয়ে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। দেখি লাঞ্ছিত সন্তোষদা লাঞ্ছনাকারীকেই ক্ষমা করার জন্য অতিশয় উদ্‌গ্রীব। বার বার তাকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ জিনিস আমি আর দেখিনি।

তাঁর ‘কিনু গোয়ালার গলি’ এক সময়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল। একের পর এক চমৎকার উপন্যাস লিখে গিয়েছেন। আর ছোট গল্পেও তিনি অসাধারণ। কিন্তু একটা বয়সের পর এবং সাংবাদিকতার চাপে তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে, মনের মতো লিখতে পারছেন না। কেন জানি না সন্তোষদা মাঝে মাঝেই আমার কাছে অকপট ভাবে দুঃখের কথা বলতেন। তার বেশির ভাগই ছিল লেখালিখি নিয়ে। পাঠক হিসেবেও ছিলেন সর্বভুক। আর লেখা ভাল লাগলে দরাজ প্রশংসায় ভরিয়ে দিতেন লেখককে।

তিনি যে রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন তা আমরা সবাই জানতাম। কিন্তু সন্তোষদা নিজে বলতেন, রবীন্দ্রনাথের সব লেখাই যদি কোনও দিন হারিয়ে যায়, তা হলেও চিন্তা নেই, আমার সব মুখস্থ আছে। বাস্তবিক রবীন্দ্রসাহিত্য তিনি গুলে খেয়েছিলেন। রবীন্দ্রগানের এত বড় সমঝদার খুব কমই দেখেছি। প্রায় প্রতিটি গানই তাঁর মুখস্থ ছিল। বিশ্বভারতী দেবব্রত বিশ্বাসের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তাতে সন্তোষদার সমর্থন ছিল বলে শোনা যায়। আসলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর আনুগত্য এতটাই ছিল যে, কেউ তাতে হস্তক্ষেপ করবে এটা তাঁর সহ্যই হত না।

ভূতের ভয় ছিল বেজায়। আসানসোলের কাছেই একটি জায়গায় সন্তোষদা, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় আর আমি একটা সাহিত্যসভায় গিয়েছি। রাতে একা ঘরে শুতে হবে জেনে সে কী চেঁচামেচি সন্তোষদার। অবশেষে কর্মকর্তাদের এক জন তাঁর ঘরে শোয়। আর সেখানেই সন্তোষদা বার বার বলছিলেন, আমার গলায় কয়েক দিন আগে মাংসের একটা হাড় ফুটেছিল তো, তাই গলাটা সব সময়ে কাঁটা-কাঁটা লাগছে। ভাল করে খেতে পারছি না। তখন বুঝতে পারিনি যে মানুষটার শেষের সেই শুরু।

বৌদি ছিলেন ভারী ভালমানুষ। খুব শান্ত, ধীর, স্থির, বেশি কথা বলতে কখনও শুনিনি তাঁকে। অথচ, এই বৌদির ভয়েই সন্তোষদা মদ্যপানের পর একটা তীব্র গন্ধের মাউথ-ফ্রেশনার বা কোনও জেল ব্যবহার করতেন। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, বৌদি কি টের পান না? অবশ্যই পান, কিন্তু সন্তোষদা হয়তো ভাবতেন, বৌদিকে তিনি সুচারু ভাবেই ফাঁকি দিচ্ছেন। বৌদির প্রতি এই সম্ভ্রমও সন্তোষদার অসাধারণ চরিত্রের পরিচয় দেয়।

কোনও একটা অনুষ্ঠানে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে শুনলাম সন্তোষদা হাসপাতালে। তার আগেই মুম্বইয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা করিয়ে এসেছেন। আবার জটিলতা দেখা দেওয়ায় নার্সিংহোমে ভর্তি হতে হয়েছে। গিয়ে দেখি কথা বলতে পারছেন না, অপারেশনের পর গলায় বোধ হয় কোনও যন্ত্র লাগানো হয়েছিল। আমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে অনেক চেষ্টায় প্রশ্ন করলেন, তুমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলে? বুঝতে পারলাম আমাকে দেখে তিনি উত্তেজিত নন, আমি যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম, সেটাই ওঁর উত্তেজনার কারণ। এতটাই ছিল তাঁর শান্তিনিকেতনের ওপর টান। ওই সঙ্কটজনক অবস্থায়ও আমি তাঁর মতো মৃত্যুভয়হীন মানুুষ বড় একটা দেখিনি।

মানুষটাকে না ভালবেসে উপায় ছিল না। কখনও শিশু, কখনও অভিভাবক। এই অগ্নিমূর্তি, এই আবার গলে জল। বর্ণময় এই মানুষটিকে মনে পড়লেই মনটা মেদুর হয়ে যায়।

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Santosh Kumar Ghosh Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE